আড়াই বছরে সবচেয়ে কম আমদানি জুনে, তারপরও রিজার্ভ কমছে

আড়াই বছরে সবচেয়ে কম আমদানি জুনে, তারপরও রিজার্ভ কমছে

আমদানি ব্যয় কমার পরও বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে। এমনি কি রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারার পরও রিজার্ভে নিম্মমূখী ধারা অব্যাহত রয়েছে।

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় কমতে কমতে এখন একেবারেই স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছে। সবশেষ গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ৪৭৩ কোটি ১০ লাখ (৪.৭৩ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। 

এই অঙ্ক গত বছরের জুনের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৩০ শতাংশ কম। আর আড়াই বছরের মধ্যে আমদানি খাতে সবচেয়ে কম বিদেশি মুদ্রা খরচ হয়েছে গত জুন মাসে। 

এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে পণ্য আমদানিতে ৪৪৫ কোটি ৭০ লাখ (৪.৪৫ বিলিয়ন) ডলার খরচ হয়েছিল বাংলাদেশের।

কিন্তু আমদানি ব্যয় কমার পরও বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও  স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে। এমনি কি রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারার পরও রিজার্ভে নিম্মমূখী ধারা অব্যাহত রয়েছে।

গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল  ২৩ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। 

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে।   

এক বছর আগে ২০২২ সালের ৩ আগস্ট ‘গ্রস’ রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। তার এক বছর আগে ২০২১ সালের আগষ্টে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। 

এর পর আমদানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় রিজার্ভ কমতে থাকে। বাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়। দিন যতো যেতে থাকে ডলারের সংকট ততোই বাড়তে থাকে। সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করতে থাকে; শক্তিশালী হতেই থাকে ডলার;কমতে থাকে টাকার মান। 

গত আড়াই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৩০ শতাংশের বেশি কমেছে। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ৮৪ টাকার ডলার এখন ১০৯ টাকা ৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তার পরও ডলার সংকট কাটছে না।

 

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৭৬  শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে পণ্য আমদানিতে ৪৪৫ কোটি ৭০ লাখ (৪.৪৫ বিলিয়ন) ডলার খরচ হয়েছিল বাংলাদেশের। এর পর থেকে আমদানিতে ব্যয় বাড়তে থাকে। ডিসেম্বরে ব্যয় হয় ৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। 

২০২১ সালের জানুয়ারিতে সেই ব্যয় এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে পণ্য আমদানিতে খরচ হয় যথাক্রমে ৫ দশমিক ১৫, ৫ দশমিক ৭০, ৫ দশমিক ৭৯, ৫ দশমিক ৬৭ ও ৬ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। 

জুলাই মাসে অবশ্য আমদানি ব্যয় কমে ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। কিন্তু পরের মাস আগস্টে তা আবার বেড়ে ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে উঠে। 

সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে আমদানিতে ব্যয় হয় যথাক্রমে ৬ দশমিক ৪৭, ৭ দশমিক ১১, ৭ দশমিক ২৬ ও ৭ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। 

২০২২ সালের জানুয়ারিতে পণ্য আমদানিতে ৭ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসে ব্যয় হয় যথাক্রমে ৭ দশমিক ৭৫, ৭ দশমিক ১৫ ও ৭ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। 

আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে বিলাসবহুল অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারও নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়।

তার পরও আমদানি ব্যয় একটা কমেনি। ২০২২ সালের মে খরচ হয় ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। জুন মাসে ব্যয় হয় ৭ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। জুলাই মাসে খানিকটা কমে ৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়নে নেমে আসে। 

আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ব্যয় হয় যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮৩, ৬ দশমিক ৬৫, ৬ দশমিক ১৫, ৭ দশমিক শূূন্য ৩ ও ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। 

চলতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে পণ্য আমদানিতে ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এর পর থেকে অবশ্য আমদানিতে নিম্মমূখী ধারা লক্ষ্য করা যায়। ফেব্রুয়ারি খরচ হয় ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। 

মার্চ মাসে ব্যয় হয় ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। এপ্রিলে খরচ হয় ৪ দশমিক ৮৪ বিলিয়নন ডলার। মে মাসে তা কিছু বেড়ে ৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পণ্য আমদানিতে খরচ বেশ কমে ৪ দশমিক ৭৩  বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। 

ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি কমেছে

আমদানি কমায় আর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) ঘাটতি তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে । 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন (৩৩৩ কোটি ৪০ লাখ) ডলার। 

আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনো অর্থবছরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে এত ঘাটতি দেখা যায়নি। 

তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে এই সূচকে ৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল। 

বাণিজ্য ঘাটতি অর্ধেকে নেমেছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ, ৩৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। শতাংশ হিসাবে গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমেছে ৪৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। 

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, “সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় কমেছে ঠিকই। এদিক দিয়ে সরকার সফল হয়েছে বলা যায়। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহও ইতিবাচক ধারায় আছে। কিন্তু রিজার্ভ কিন্তু অনেক কমে গেছে।”

“ডলার সংকট এখনও রয়ে গেছে। এ অবস্থায় রিজার্ভ যদি আরও কমে যায়, তাহলে কিন্তু বিপদ আছে। তাই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আনতে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে রপ্তানি আয় ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কম সুদের বিদেশি ঋণ ও এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) বাড়াতেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।” 

গত অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে পাহাড়সম ঘাটতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল মন্তব্য করে অর্থনীতির বিশ্লেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রিজার্ভ বাড়ানোই এখন অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রিজার্ভ বাড়লে ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।”  

“এখানে আরেকটি বিষয় আছে, আমদানি কমলে কিন্তু দেশে বিনিয়োগ কমে যাবে। কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কাঙ্খিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। তবে, আমি মনে করি, জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দিকেই এখন সরকারের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।  

“বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে চলতি অর্থবছরে ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিও যদি অর্জিত হয়, তাও সেটা যথেষ্ট বলে বলে আমি মনে করি।” 

মাংস আমদানির অনুমতি চায় রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি পরবর্তী

মাংস আমদানির অনুমতি চায় রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর