দেড় মাসে কোনো চাল আমদানি হয়নি
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দেড় মাসে সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই কোনো চাল আমদানি হয়নি। এই সময়ে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৪১০ টন গম আমদানি হয়েছে। ফাইল ছবি
গত কয়েক মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনের কারণে খুব একটা চাল আমদানি করতে হচ্ছে না।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত থাকার পরও আপদকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য আগামী প্রস্তুতি হিসেবে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬০ মেট্টিক টন চাল আমদানি হয়েছিল। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪০ লাখ টন এবং বেসরকারি পর্যায়ে ৪ লাখ ২১ হাজার ৬২০ টন চাল হয়।
তবে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দেড় মাসে (১ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট) সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই কোনো চাল আমদানি হয়নি। এই সময়ে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৪১০ টন গম আমদানি হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ৬৬০ টন খাদ্য আমদানি হয়েছিল। এর মধ্যে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬০ টন চাল ও ৩৮ হাজার ৭৫ হাজার ১০০ গম আমদানি হয়।
গত ১২ জুলাই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিতে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ৫ লাখ টন চাল এবং ৬ লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন খাদ্য অধিদপ্তরকে জিটুজি ভিত্তিতে ও আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এই চাল ও গম আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ১৯ জুলাই ভারত চাল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ায় আপাতত চাল আমদানি নিয়ে খুব একটা ভাবছে না সরকার।
ভারত চাল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর আমদানি করা হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর চাল মজুত আছে। এই মুহূর্তে চাল আমদানি না করলেও আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। আপদকালীন সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করায় বিশ্ববাজারে চালের দাম অনেক বেড়ে গেছে।”
“এখন অন্য দেশ থেকে চাল আমদানি করলে খরচ অনেক বেশি পড়বে। তাই আমরা অপেক্ষা করছি।”
এদিকে ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ এবং ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে নিরাপদে শস্য রপ্তানির চুক্তি রাশিয়া নবায়ন না করায় বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিয়ে নতুন করে সংকট দেখা দেওয়ার মধ্যেই সর্বকালের সর্বোচ্চ মজুত গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুত ২০ লাখ ৪৩ হাজার মেট্টিক টন ছাড়িয়ে গেছে।
অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহের ওপর ভর করে বেড়েছে এই মজুত। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সরকারের গুদামে এত খাদ্য মজুত ছিল না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বুধবার দেশের সরকারি গুদামগুলোতে সব মিলিয়ে ২০ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬৩ মেট্টিক টন খাদ্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ১৭ লাখ ৫১ হাজার ৮৬ টন, গম ১ লাখ ১৯ হাজার ৭০২ টন এবং ধান ১ লাখ ১১ হাজার ৯৬২ টন।
অতীতের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই মজুত ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে ২০ লাখ ১০ হাজার টনে উঠেছিল। যা ছিল এত দিন রেকর্ড। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই সরকারিভাবে এত খাদ্যশস্য মজুত ছিল না। কিন্তু এর পর থেকে কমতে কমতে সেই মজুত গত বছরের মে মাস শেষে ১২ লাখ ৫২ হাজার টনে নেমে আসে।
এরই মধ্যে এপ্রিল থেকে দেশে বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করে সরকার। আমদানিও বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে আবার বাড়তে থাকে খাদ্যের মজুত; আমন সংগ্রহ অভিযান এবং চাল আমদানি বাড়ায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সরকারি মজুত ১৯ লাখ টনে গিয়ে দাঁড়ায়।
এর পর বেরো মৌসুম শুরু হয়; বোরোর বাম্পার ফলনে আমদানি ছাড়াই এখন প্রতিদিনই বাড়ছে মজুত। চলতি আগস্ট মাস জুড়েই চলবে বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। মজুত আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
‘খাদ্য নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নেই’ জানিয়ে মন্ত্রী এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “বিশ্বে যাই হোক না কেনো, ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করলেও আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমাদের প্রচুর খাদ্য মজুুত আছে। কিছু দিন পর আউশ ধান উঠবে। তার পর আমন ধান উঠবে। আগামী দেড়-দুই বছর আমাদের কোনো চিন্তা নেই।”
বর্তমান মজুতকে ‘সন্তোষজনক’ উল্লেখ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বুধবার পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১২ লাখ ৫ হাজার ৩৩৩ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮৬ টন ধান এবং ১০ লাখ ৭৫ হাজার ৫৩ হাজার ৫৪০ টন চাল।
বাম্পার ফলনেও কমছে না চালের দাম
আমনের পর বোরো ধানেরও বাম্পার ফলন হয়েছে দেশে। কিন্তু তারপরও বাজারে চালের দাম কমছে না। তবে গত এক-দেড় বছরে চালের দাম বাড়েনি; একই জায়গায় ‘স্থির’ আছে। মাস খানেক আগে মোটা চালের দাম কেজিতে ২/১ টাকা বেড়েছিল। এর পর আর বাড়েনি।
আমন-বেরোর বাম্পার ফলনের পরও বাজারে চালের দাম কমছে না কেন- এ প্রশ্নের উত্তরে কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “চালের দাম আসলে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। কৃষক তো আর সরাসরি বাজারে চাল বিক্রি করেন না। বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে সেই ধান থেকে চাল করে বাজারে বিক্রি করে। এ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের ঘটনা ঘটে, কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। সরকার বাজার ভালোভাবে মনিটর না করার কারণেই চালের দাম কমছে না।”
তিনি বলেন, “চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। সরকারি গুদামগুলোতে সাড়ে ২০ লাখ টন চাল মজুত রয়েছে। কৃষকের কাছেও প্রচুর চাল রয়েছে। কিছু দিন পর আউশ ধান উঠবে; তারপর আমনও উঠবে। সে কারণে এখন চালের দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই।”
তিনি বলেন, “ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করেছে-এই অজুহাতে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে চালের দাম বাড়ানোর পায়তারা করছে। ইতোমধ্যে বাড়ানোও শুরু করে দিয়েছে। তাহলে এক-দেড় বছর চালের দাম স্থিতিশীল থাকলেও হঠাৎ করে মোটা চালের দাম বাড়বে কেন?”
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আগামী এক-দেড় বছর আমাদের চাল নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আমাদের যা মজুত আছে তা দিয়ে অনায়াসে এক বছর চলে যাবে। আউশের ভালো ফলন হবে বলে আমি সারা দেশে খবর নিয়েছি। সে কারণে ভারত কি করল, সেই অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে চালের দাম না বাড়াতে পারে-তা এখনই শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
কমেন্ট