তুলা আমদানিতে বছরে ব্যয় ৩৩ হাজার কোটি টাকা
বর্তমানে এক কেজি তুলা উৎপাদনের ফলে ৩ ডলার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয় এবং প্রতি টন বীজতুলা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ৫ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের প্রধান কাঁচামাল তুলা আমদানিতে বছরে ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। বিটি তুলা চাষ করে বিশ্বের অনেক দেশ আমদানিকারক দেশ হতে রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশও সেই পথে অগ্রসর হতে পারে।
বর্তমানে এক কেজি তুলা উৎপাদনের ফলে ৩ ডলার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয় এবং প্রতি টন বীজতুলা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ৫ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়।
রোববার বিটি তুলার দুটি জাত অবমুক্ত উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে এ সব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের (সিডিবি) নির্বাহী পরিচালক ফখরে আলম ইবনে হাবিব।
তিনি বলেন, “বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানিতে বছরে ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। বিটি তুলা চাষ করে বিশ্বের অনেক দেশ আমদানিকারক দেশ হতে রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।”
প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বিটি তুলার গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৪৫০০ কেজি। বলওয়ার্ম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় ১২ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ কমবে এবং উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে। বিটি তুলা চাষে প্রাকৃতিক দূষণ কম ও কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই।
বর্তমানে হাইব্রিড তুলা চাষ লাভজনক। দুই বিঘা তুলা চাষে একজন কৃষক এক লাখ টাকারও বেশি আয় করতে পারেন। এছাড়াও, তুলা বীজ বপনের পর প্রথম দেড় মাস স্বল্পকালীন শাক-সবব্জি (যেমন: লাল শাক, ডাটা শাক), মসলা জাতীয় ফসল (যেমন: গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ, ধনেপাতা) এবং ডাল জাতীয় ফসল (যেমন: মুগ, মাসকলাই) আবাদ করে চাষিরা বাড়তি আয় করতে পারেন।
বর্তমানে এক কেজি তুলা উৎপাদনের ফলে তিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয় এবং প্রতি টন বীজতুলা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ৫ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়।
তুলা থেকে আঁশ ছাড়াও ভোজ্য তেল, খৈল ও জ্বালানি উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। তুলা বীজ থেকে ১৫-২০% ভোজ্য তেল পাওয়া যায়, যা উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ ও পুষ্টিকর। তুলা চাষের পর একই জমিতে বোরো ধান, আউশ ধান, ভুট্টা, মুগ, তিল বিভিন্ন এলাকায় লাভজনকভাবে আবাদ করা হচ্ছে বলে মূল প্রবন্ধে জানানো হয়।
এ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর দেশে বিটি তুলার দুটি জাত চাষের জন্য রোববার অবমুক্ত করেছে সরকার।
রাজধানীর ফার্মগেটে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মিলনায়তনে দেশে প্রথমবারের মতো বিটি তুলার জাতের অবমুক্ত করেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
অন্যান্য জাতের চেয়ে অবমুক্ত হওয়া ভারতের জে কে এগ্রি-জেনেটিক্স লিমিটেডের উদ্ভাবিত জে কে সি এইচ ১৯৪৭ বিটি এবং জে কে সি এইচ ১৯৫০ বিটির ফলনও দ্বিগুণ হবে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।
কৃষিমন্ত্রী রাজধানীর খামার বাড়ি সড়কে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নতুন তুলা ভবন উদ্বোধন করেন।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এই তুলার আবাদ শুরু হলে দেশে তুলার উৎপাদন এখনকার দুই লাখ বেল থেকে বাড়িয়ে ১৫ লাখ বেলে উন্নীত করা সম্ভব হবে।
বিশ্বে ১৯৯৬ সালে প্রথম বিটি তুলার চাষ করা হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০০২ সালে বিটি তুলার চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশে বায়োসেইফটি গাইডলাইন অনুযায়ী সব গবেষণা কার্যক্রম শেষ করার পর গত ৭ মে ন্যাশনাল কমিটি অন বায়োসেইফটি ভারতের জে কে এগ্রি-জেনেটিক্স লিমিটেডের উদ্ভাবিত দুটি জাতকে চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করার অনুমোদন দেয়।
এই দুটি জাত হলো-জে কে সি এইচ ১৯৪৭ বিটি এবং জে কে সি এইচ ১৯৫০ বিটি।
অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “দেশে বছরে ৮৫ লাখ বেল তুলা প্রয়োজন হয়, আর উৎপাদন হয় মাত্র দুই লাখ বেল। চাহিদার কমপক্ষে ২০ শতাংশ বা ১৫ লাখ বেল তুলা দেশে উৎপাদন করার সুযোগ রয়েছে। সে লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতে হবে। হাইব্রিড ও বিটি তুলার চাষ করতে পারলে বছরে দেশে ১৫ লাখ বেল তুলা উৎপাদন সম্ভব হবে।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ মো. বখতিয়ার, বিএডিসির চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস, সিডিবির অতিরিক্ত পরিচালক শেফালী রানী মজুমদার বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ এ খাতে তৈরি হয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থান। তবে সর্বাধিক রপ্তানির এ খাতেও রয়েছে নানান সমস্যা। বিশেষ করে সুতার জন্য আমদানিনির্ভরতা এ খাতে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।
সুতা তৈরির জন্য প্রয়োজন তুলা, যার প্রায় পুরোটাই দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এতেই প্রতি বছর চলে যাচ্ছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা।
চাহিদার তুলনায় দেশে তুলার উৎপাদন ২ শতাংশেরও কম।
বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তুলা আমদানিকারক বাংলাদেশ। চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮৫ লাখ বেল তুলার চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে দেশে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র এক লাখ ৭৬ হাজার বেল, যা চাহিদার দুই শতাংশও পূরণ করতে পারছে না।
এ কারণে ঘাটতি মেটাতে প্রতি বছর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে ৮৩ লাখ বেলের বেশি তুলা।
সিডিবির তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হয়; উৎপাদন হয় এক লাখ ৭৬ হাজার ২৮৬ বেল তুলা।
যদিও প্রতিবছর তুলার উৎপাদন বাড়ার তথ্য দিচ্ছে সিডিবি। সংস্থাটি বলছে, দেশে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তুলার উৎপাদন ছিল এক লাখ ৫৩ হাজার বেল, যা গত পাঁচ বছরে ২৩ হাজার বেল বেড়েছে। সংস্থাটি আমদানিনির্ভরতা কমাতে ২০৪১ সালের মধ্যে ২০ লাখ বেল তুলা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে।
এ লক্ষ্য পূরণের জন্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর দেশে বিটি তুলার দুটি জাত চাষের জন্য অবমুক্ত করেছে সরকার।
২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে মোট আমদানি করা তুলার মধ্যে ভারত থেকে ১৯ শতাংশ, মালি থেকে ১৩, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১২, ব্রাজিল ও বেনিন থেকে ১০ শতাংশ করে তুলা সংগ্রহ করা হয়। বাকি তুলা আরও কিছু দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছর শুধু ভারত থেকেই ৩২ শতাংশ তুলা এসেছে। এরপর আছে ব্রাজিল (১৫%), বেনিন (১২%) ও যুক্তরাষ্ট্র (৯%)।
কমেন্ট