জুলাইয়ে এলসি কমেছে ৩১ শতাংশ, তার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না

জুলাইয়ে এলসি কমেছে ৩১ শতাংশ, তার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না

ডলার সংকটের কারণে বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় এলসি খোলায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু হলো।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৪৩৭ কোটি ২৪ লাখ (৪.৩৭ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র বা এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা উদ্যোক্তারা। 

এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩১ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই মাসে ৬৩৫ কোটি ৪০ লাখ (৬.৩৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। 

অন্যদিকে এলসি নিস্পত্তি কমেছে ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ। এই জুলাইয়ে ৭৪৯ কোটি ১৮ লাখ (৭.৪৯ বিলিয়ন) ডলারের এলসি নিস্পত্তি হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে ৫৯৮ কোটি ৩০ লাখ (৫.৯৮ বিলিয়ন) ডলারের এলসি নিস্পত্তি হয়েছিল। 

ডলার সংকটের কারণে বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় এলসি খোলায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু হলো। 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে (২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩  সালের জুন) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য সব মিলিয়ে সাত হাজার ২১৯ কোটি ৮০ লাখ (৭২.২০ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা উদ্যোক্তারা। 

যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে প্রায় ২৬ শতাংশ কম। 

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতেই আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। তার সুফলও মিলছে।

তার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না; বাড়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। 

আগের সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (১৬ আগস্ট) ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম৬ হিসাবে ছিল  ২৩ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। 

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো নিয়ে সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে রিজার্ভের হালনাগাদ এই তথ্য পাওয়া গেছে। 

গত ১২ জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

ওই দিন ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। 

এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত দেড় মাসে ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৬৫ কোটি ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে কমেছে ৪১ কোটি ডলার। 

আমদানি কমায় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ২০২১ সালের আগস্টে এই রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের (গ্রস রিজার্ভ, তখন বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করা হত না) মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। 

এরপর আমদানি বাড়ায় এবং রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স হোঁচট খাওয়ায় রিজার্ভ কমতে থাকে। চাপ বাড়তে থাকে অর্থনীতিতে। 

সে পরিস্থিতিতে গত বছরের এপ্রিল থেকে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে নেয়া হয় একের পর এক পদক্ষেপ। 

তাতে আমদানি খরচ বেশ কমে এসেছে। কিন্তু রিজার্ভের পতন ঠেকছে না। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে; তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও  ব্যাংকাররা। 

বৃহস্পতিবার আমদানি সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, জুলাই মাসে খাদ্য (চাল ও গম) আমদানির এলসি কমেছে ২১ দশমিক শূন্য এক শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। 

নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনি যন্ত্রপাতি) আমদানির এলসি কমেছে সবচেয়ে ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। 

শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমেডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি কমেছে ৩০ দশমিক ৬৫ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১৭ শতাংশ। 

জ্বালানি তেলের এলসি কমেছে ৫০ দশমিক ১২ শতাংশ; নিস্পত্তি বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। 

শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ৩৬ দশমিক ১২ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ২৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। 

এছাড়া নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে অন্যান্য পণ্য আমদানির এলসি কমেছে ১৮ দশমিক ৬২ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। 

এলসি খোলার জুলাই মাসের তথ্য প্রকাশ করলেও সার্বিক আমদানি ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

 

২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে মোট ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম। 

দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গত বছরের মার্চে দেশে মার্কিন ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা এখনো কাটেনি। 

অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পণ্য আমদানিতে তারা চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সেবা দিয়ে যে আয় ও মুনাফা করেছে, তা-ও নিজ দেশে নিতে পারছে না। 

বাজারে চাহিদা বাড়লেও জোগান কমছে ডলারের। আর এতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে এই বিদেশি মুদ্রার দর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় উঠেছে। 

এক বছর আগে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ। 

প্রয়োজনীয় আমদানি অব্যাহত রাখতে দুই বছরের বেশি সময় ধরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি অর্থবছরের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত (প্রায় দুই মাস) বিক্রি করা হয়েছে দেড় বিলিয়ন ডলারের মত। 

তবে সব ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু সরকারের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। 

এ বিষয়ে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রিজার্ভ কমে গেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করছে যত কম এলসি খোলা হয়। এর মাধ্যমে রিজার্ভ ধরে রাখতে চাইছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু রিজার্ভ কমছেই। আকুর দেনা শোধের পর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আরও কমে যাবে।” 

তিনি বলেন, “এলসি খোলা কমানোর প্রভাব পড়বে সমগ্র অর্থনীতির ওপর। কারণ, মূলধন যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ আরও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কমেছে। এর ফলে দেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্প উৎপাদন কমে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে কোটা চেয়ে ফের চিঠি পরবর্তী

ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে কোটা চেয়ে ফের চিঠি

কমেন্ট