আমদানি কমলেও স্বস্তি ফিরছে না অর্থনীতিতে

আমদানি কমলেও স্বস্তি ফিরছে না অর্থনীতিতে

বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমছেই। মূল্যস্ফীতির পারদ নামছে না; খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে। দিন যত যাচ্ছে, অর্থনীতিতে উদ্বেগ ততই বাড়ছে।

ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল; তার সুফলও মিলছে।

আমদানি ব্যয় বেশ কমে এসেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স কমলেও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। আর এতে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে; বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে।

তার পরও স্বস্তি ফিরছে না অর্থনীতিতে। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমছেই। মূল্যস্ফীতির পারদ নামছে না; খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে। দিন যত যাচ্ছে, অর্থনীতিতে উদ্বেগ ততই বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০১ কোটি ২০ লাখ (১.০১ বিলিয়ন) ডলার।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল সাড়ে চারগুণ বেশি, ৪৫৭ কোটি ৬০ লাখ (৪.৫৭ বিলিয়ন) ডলার।

জুলাই-আগস্ট সময়ে ৯৮৬ কোটি ২০ লাখ (৯.৮৬ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৩০ শতাংশ কম।

২০২২-২৩ অর্থবছরের এই দুই মাসে ১২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।

অন্যদিকে এই বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৮ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক শূন্য চার শতাংশ বেশি।

গত বছরের এই দুই মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৮ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।

এ হিসাবেই চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ কমে ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এই ঘাটতি ৩৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।

লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত বাড়ছে

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই দুই মাসে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ছিল।

আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছর।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনো অর্থবছরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে এত ঘাটতি দেখা যায়নি।

আমদানি কমায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই ঘাটতি ৩৩৩ কোটি (৩.৩৩ বিলিয়ন) ডলারে নেমে এসে অর্থবছর শেষ হয়েছিল।

২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়েছিল।

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, “সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে পণ্য আমদানি ব্যয় কমেছে। সে কারণে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি কমেছে। এটা ভালো দিক। তবে ডলারসংকট কিন্তু কাটেনি। এখনো রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কমতে কমতে রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।”

“এখন প্রশ্ন হচ্ছে-রিজার্ভ আর কত কমবে? রিজার্ভ যাতে আর না কমে, সেদিকে এখন সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আর সে কারণে রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে হবে। রেমিটেন্স বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতা সংস্থার ঋণগুলোর ঋণ যাতে দ্রুত পাওয়া যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করে। পুরো অর্থবছরে সেই উল্লম্ফন দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়।

ওই অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও উল্লম্ফন হয়েছিল; ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিটেন্স কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। সে কারণেই ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি চূড়ায় উঠেছিল।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “ব্যালান্স অব পেমেন্টে উদ্বৃত্ত দেখা দিলেও অর্থনীতিতে স্বস্তি কিন্তু ফিরে আসছে না। ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, রিজার্ভ না বাড়লে কিন্তু ডলারের দাম কমবে না। তাই রিজার্ভ বাড়ানোর দিকেই এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে সরকারকে।”

“আমদানি ব্যয় কমিয়ে নয়, রেমিটেন্স, রপ্তানি আয় ও কম সুদের বিদেশি ঋণ বাড়িয়ে রিজার্ভ বাড়তে হবে,” বলেন দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা এই অর্থনীতিবিদ।

বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর।

তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।

রেমিটেন্স কমেছে ১৩.৫৫ শতাংশ

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ কম।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।

রিজার্ভ কমছেই

বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আরও কমেছে।

বুধবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৭ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারে।

গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৭ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।

২০২১ সালের আগস্টে এই রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

সেবা বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-আগস্টে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ৬৪ কোটি ২০ লাখ ডলার।

মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি কমেছে

সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে (ওভারঅল ব্যালান্স) ঘাটতি কমেছে। জুলাই-আগস্ট সময়ে এই সূচকে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।

গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।

আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে

জুলাই-আগস্ট দুই মাসে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার।

গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল অনেক কম, ২৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

আর্থিক হিসাবে ধারাবাহিক উদ্বৃত্ত থেকে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ।

অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে এই সূচকে ১৫ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত ছিল।

করোনা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণ-সহায়তা পাওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত ছিল বলে জানান আহসান মনসুর।

কিন্তু গত অর্থবছরে দাতাদের ঋণ-সহায়তা বেশ কমে যায়। চলতি অর্থবছরেও সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে মনে করেন মনসুর।

আরও ৬ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি পরবর্তী

আরও ৬ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর