তিন মাসে এলসি কমেছে ১৮ শতাংশ, তার পরও রিজার্ভ নামছেই

তিন মাসে এলসি কমেছে ১৮ শতাংশ, তার পরও রিজার্ভ নামছেই

ডলার সংকটের কারণে বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় এলসি খোলায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু হয়। তিন মাস পার হয়ে গেলেও সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য এক হাজার ৫৮৯ কোটি ১২ লাখ (১৫.৮৯ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র বা এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।

এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১৬ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিস্পত্তি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ২২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে এই তিন মাসে এলসি নিস্পত্তি কমেছে ২৫ দশমিক ৪০ শতাংশ।

তার পরও বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছেই।

ডলার সংকটের কারণে বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় এলসি খোলায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু হয়।

তিন মাস পার হয়ে গেলেও সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মূলধন যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের কাঁচামালসহ সব পণ্যের আমদানি কমেছে।

অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আর তাতে দেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্প উৎপাদন কমে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে (২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য সব মিলিয়ে সাত হাজার ২১৯ কোটি ৮০ লাখ (৭২.২০ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।

যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে প্রায় ২৬ শতাংশ কম।

রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতেই আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। তার সুফলও মিলছে। তার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলারের নিচে—২০ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর ‘গ্রস’ হিসাবে নেমেছে ২৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে।

নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ আরও কমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭০ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ডিসেম্বরে পাওয়া যাবে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ধস নেমেছে। বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও বিনিয়োগেও (এফডিআই) ভালো খবর নেই।

এই পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের আকুর বিল যদি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারও হয়, তাহলেও বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে।

গত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ওই দিন ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত সাড়ে তিন মাসে ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ হিসাবে কমেছে ২ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

আমদানি কমায় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ২০২১ সালের আগস্টে এই রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের (গ্রস রিজার্ভ, তখন বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করা হত না) মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।

এক বছর আগে ১৮ অক্টোবর ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ৩৬ দশমিক ১১  বিলিয়ন ডলার।

এরপর আমদানি ধীরে ধীরে বাড়ায় এবং রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স হোঁচট খাওয়ায় রিজার্ভ কমতে থাকে। চাপ বাড়তে থাকে অর্থনীতিতে।

সে পরিস্থিতিতে গত বছরের এপ্রিল থেকে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে নেয়া হয় একের পর এক পদক্ষেপ। তাতে আমদানি খরচ বেশ কমে এসেছে। কিন্তু রিজার্ভের পতন ঠেকছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার এলসি খোলার হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে খাদ্য আমদানির এলসি কমেছে ৪৭ দশমিক ৮০ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১৯ দশমিক ৯১ শতাংশ।

নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনি যন্ত্রপাতি) আমদানির এলসি কমেছে ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ৩৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।

শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমেডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি কমেছে ২৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ।

জ্বালানি তেল আমদানির এলসি কমেছে ১২ দশমিক ৪১ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ২২ দশমিক ৫৯ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ৩৬ দশমিক ২২ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের সার্বিক আমদানি ব্যয়ের তথ্য এখনও প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

দুই মাসের অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট সময়ের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, এই দুই মাসে পণ্য আমদানিতে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ৯ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে।

যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৩০ শতাংশ কম।

২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে মোট ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম।

প্রায় পৌনে দুই বছর সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গত বছরের মার্চে দেশে মার্কিন ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা এখনো কাটেনি। উল্টো দিন যতো যাচ্ছে, সংকট ততোই বাড়ছে।

অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পণ্য আমদানিতে তারা চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সেবা দিয়ে যে আয় ও মুনাফা করেছে, তা-ও নিজ দেশে নিতে পারছে না।

বাজারে চাহিদা বাড়লেও জোগান কমছে ডলারের। আর এতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে এই বিদেশি মুদ্রার দর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় উঠেছে।

কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে প্রতি ডলার প্রায় ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এক বছর আগে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ দর।

প্রয়োজনীয় আমদানি অব্যাহত রাখতে দুই বছরের বেশি সময় ধরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি অর্থবছরের সাড়ে তিন মাসে (১ জুলাই থেকে ১৮ অক্টোবর) ৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

তবে সব ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু সরকারের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করছে যত কম এলসি খোলা হয়। এর মাধ্যমে রিজার্ভ ধরে রাখতে চাইছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু তার পরও রিজার্ভ কমছেই। আকুর দেনা শোধের পর আরও কমে যাবে।”

তিনি বলেন, “এলসি খোলা কমানোর প্রভাব পড়বে সমগ্র অর্থনীতির ওপর। কারণ মূলধন যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ আরও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কমেছে। এর ফলে দেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্প উৎপাদন কমে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

‘তবে এই মুহূর্তে এর বিকল্পও নেই’ মন্তব্য করে দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর বলেন, “এখন সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিৎ রিজার্ভ বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে। রিজার্ভ যাতে আর না কমে সেজন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স বাড়াতে হবে, অবৈধ হুন্ডির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে রপ্তানি আয়, বিদেশি ঋণ ও এফডিআই বাড়ানোর দিকেও জোর দিতে হবে।”

আরও ৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি পরবর্তী

আরও ৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর