৫ মাসে এলসি কমেছে ১৪%, বিনিয়োগ কমার শঙ্কা

৫ মাসে এলসি কমেছে ১৪%, বিনিয়োগ কমার শঙ্কা

জুলাই-নভেম্বর সময়ে ২৭ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিস্পত্তি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ৩৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে এই পাঁচ মাসে এলসি নিস্পত্তি কমেছে ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ২ হাজার ৭৫৩ কোটি ২২ লাখ (২৭.৫৩ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র বা এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।

এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে ৩২ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, জুলাই-নভেম্বর সময়ে ২৭ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিস্পত্তি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ৩৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে এই পাঁচ মাসে এলসি নিস্পত্তি কমেছে ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

ডলার সংকটের কারণে বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় এলসি খোলায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শুরু হয়।

পাঁচ মাস পার হয়ে গেলেও সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মূলধন যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের কাঁচামালসহ সব পণ্যের আমদানি কমেছে।

অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আর তাতে দেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্প উৎপাদন কমে যাবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে (২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য সব মিলিয়ে ৭ হাজার ২১৯ কোটি ৮০ লাখ (৭২.২০ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।

যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে প্রায় ২৬ শতাংশ কম।

রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতেই আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। তার সুফলও মিলছে। বছরের শেষ দিকে এসে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও বেশ খানিকটা বেড়েছে।

গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।

এক সপ্তাহ আগে ২১ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ৭৭ কোটি ডলার। আর ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়েছে ৭৮ কোটি ডলার।

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের বহুল প্রতিক্ষিত দ্বিতীয় কিস্তি ৬৯ কোটি ডলার, ম্যালিাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৪০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৯ কোটি ডলার যোগ হওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।

এছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ডলার কেনার ফলে রিজার্ভ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। আমদানি কমায় রিজার্ভ বাড়ার একটি কারণ বলেও মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা।

আইএমএফ, এডিবি ও কোরিয়ার ঋণ যোগ হওয়ার আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “স্বস্তির খবর এই যে, আইএমএফ, এডিবি ও কোরিয়ার ঋণ পাওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে। নির্বাচনের আগে হয়ত রিজার্ভ আর কমবে না।”

“তবে নির্বাচনের দু-একদিন পরই কিন্তু আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন কিন্তু রিজার্ভ সেই আগের অবস্থায় নেমে আসবে।”

“সে কারণে রিজার্ভ বাড়াতে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে আরও ঋণ-সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।”

যেসব ঋণ পাইপলাইনে আটকে আছে, সেগুলো দ্রুত ছাড় করাতে দাতাদের সঙ্গে দেন-দরবার করার পরামর্শ দেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর।

গত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আমদানি কমায় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের (গ্রস রিজার্ভ, তখন বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করা হত না) মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।

এক বছর আগে ২৭ ডিসেম্বর ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ৩৩ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার।

রিজার্ভ ধরে রাখতে গত বছরের এপ্রিল থেকে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে নেয়া হয় একের পর এক পদক্ষেপ। আর তাতেই আমদানি খরচ বেশ কমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার এলসি খোলার হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে খাদ্যপণ্য আমদানির এলসি কমেছে ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ২২ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ।

নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনি যন্ত্রপাতি) আমদানির এলসি কমেছে ১৭শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ৩৬ শতাংশ।

শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমেডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি কমেছে ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১১ দশমিক শূন্য আট শতাংশ।

জ্বালানি তেল আমদানির এলসি কমেছে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১১ দশমিক ১২ শতাংশ।

শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ৩৩ দশমিক ৬১ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ের সার্বিক আমদানি ব্যয়ের তথ্য এখনও প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

চার মাসের অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবর সময়ের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, এই চার মাসে পণ্য আমদানিতে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ২০ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে।

যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৫৪ শতাংশ কম।

২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে মোট ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম।

প্রায় দুই বছর সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গত বছরের মার্চে দেশে মার্কিন ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা এখনো কাটেনি।

অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পণ্য আমদানিতে তারা চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর তিন দফায় (৫০ পয়সা, ২৫ পয়সা ও ২৫ পয়সা) ১ টাকা কমেছে।

আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় উঠেছিল। এখন ১১০ টাকায় নেমে এসেছে।

তবে কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে প্রতি ডলার এখনও ১২০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। কিছু ব্যাংক ১২০ টাকায় রেমিটেন্স সংগ্রহ করছে। এলসি খুলতেও ১১৯/১২০ টাকা নিচ্ছে।

আহসান মনসুর বলেন, “আমদানি কমার প্রভাব পড়বে সমগ্র অর্থনীতির ওপর। কারণ মূলধন যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ আরও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কমেছে। এর ফলে দেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্প উৎপাদন কমে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

‘তবে এই মুহূর্তে এর বিকল্পও নেই’ মন্তব্য করে আহসান মনসুর বলেন, “এখন সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিৎ রিজার্ভ বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে। রিজার্ভ যাতে আর না কমে সেজন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স বাড়াতে হবে, অবৈধ হুন্ডির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে রপ্তানি আয়, বিদেশি ঋণ ও এফডিআই বাড়ানোর দিকেও জোর দিতে হবে।”

৪ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ৬০ শতাংশ পরবর্তী

৪ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ৬০ শতাংশ

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর