১ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ছয় মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা কমেছে। তবে এক বছরের হিসাবে ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
নানা ধরনের ছাড় দিয়ে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার সবশেষ যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
তিন মাস আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। ছয় মাস আগে জুন শেষে ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ছয় মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা কমেছে। তবে এক বছরের হিসাবে ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।
এ হিসাবেই বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ।
অর্থাৎ ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ৯ শতাংশ এখন খেলাপি। সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। জুন শেষে ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।
অথচ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। হিসাব বলছে, ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৬ গুণ।
যেভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিগত ২০২০ ও ২০২১ সালে কোনো ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত ছিলেন গ্রাহকেরা। ২০২২ সালে এসব নীতি ছাড় তুলে দেওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয় চলতি বছরের শুরু থেকেই।
এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে ব্যাংকঋণ পরিশোধে আবার ছাড় দেয়। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আগামী জুন মাসের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিলেই একজন গ্রাহককে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের ফলে যেসব ঋণ গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তারা অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে থাকার সুযোগ পান। এই সুবিধা দেওয়া হয় শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের প্রায় অর্ধেকেই মেয়াদি ঋণ।
এত সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি কেবল বাড়ছেই; বরং বারবার ছাড় দেওয়ার কারণে ভালো গ্রাহকেরাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তাদের মতে, এতে ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে পড়ছে এবং নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে।
এদিকে গত বছর জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়। এর ফলে খেলাপিরাও ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। নতুন আইনের কারণে সামনের দিনগুলোতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি
মূলত ২০১৫ সাল থেকে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় বড় ছাড় দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খেলাপিরা বারবার ঋণ পুনঃ তফসিল করে নিয়মিত দেখাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তারা নতুন করে ঋণও নিচ্ছেন এবং নতুন করে খেলাপি হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের আগস্টে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির চেয়ে পুনঃ তফসিল ঋণের পরিমাণ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃ তফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।
২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টম্বর) ব্যাংক খাতে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে; যা ২০২২ সালের একই সময়ের চেয়ে ৬৩ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।
পুনঃতফসিল নীতিমালায় শিথিলতা আনার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিলে ঝুঁকছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ১১ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের একই সময়ে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ১৮ হাজার ৮১২ কোটি টাকা।
এর বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে আরও প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি, শতাংশ হারে যা প্রায় ৩০ শতাংশ।
সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ শতাংশ দেখালেও প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পুনঃ তফসিল করা ঋণ ও আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়া ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখানোর পক্ষে। আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়ে রেখেছে। এ শর্তও আপাতত পূরণ হচ্ছে না বলেই দেখা যাচ্ছে।
যত ছাড়, তত বেশি খেলাপি
ঋণখেলাপিদের উদার হস্তে ছাড় দেওয়া শুরু করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর। নতুন করে ক্ষমতায় এসে ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের জন্য ঋণ পুনঃ তফসিলের বিশেষ এক স্কিম হাতে নেয়। তখন তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃ তফসিল করা যেত না। কিন্তু বেশির ভাগ প্রভাবশালী উদ্যোক্তাই তিনবার সুযোগটি নিয়েও খেলাপি হয়ে পড়েছিলেন।
ফলে ঋণ পুনর্গঠন নামে নতুন এক সুবিধা দেওয়া হয়। ওই সুবিধার আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তারপরও এসব গ্রুপের বেশির ভাগই ঋণের কিস্তি আর পরিশোধ করেনি।
আবার বড় ছাড় দেওয়া হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর। ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী হয়েই আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের ইতিহাসে ঋণখেলাপিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধাটি দেন। সে সময় ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রাখা হয়। নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেওয়া হয়, এর মধ্যে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হয়নি। সেই সুযোগ নেওয়া বেশির ভাগই পরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
অথচ অর্থমন্ত্রী ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসেই এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। তখন দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। সেই খেলাপি বেড়ে এখন প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কেবল পরিমাণে নয়, শতাংশ হারেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
আর আইএমএফের দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী পুনঃ তফসিল ও মামলায় আটকে থাকা ঋণের হিসাবে নিলে পরিমাণ ও শতাংশ হারে খেলাপি ঋণ বেড়েছে বহুগুণ।
বিশাল অঙ্কের এই ঋণ খেলাপি নিয়ে সবচেয়ে জোরালো কথা বলেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আজ ব্যাংকিং খাতের যে দুরাবস্থা তার জন্য খেলাপি ঋণ দায়ি: বড় বড় ঋণ খেলাপিরা দায়ি। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংকিং খাতে কখনই সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না।”
“বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। এ দুই ঋণকে বিবেচনায় নিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যত দিন ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আলাদাভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে না, তত দিন খেলাপি ঋণও কমবে না।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদ ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলেছিলেন।
“কিন্তু কোনো সরকারই এ উদ্যোগ নেয়নি। খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঘোড়াকে থামাতে হলে ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দের পাশাপাশি তাদের জেলের ভাত খাওয়াতে হবে। তাহলে হয়তো এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। যত দিন এ কাজ করা যাবে না, তত দিন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।”
রোডম্যাপ কাজে আসবে না
এদিকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে ১০ শতাংশ ও বেসরকারি খাতে ৫ শতাংশে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি এই রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সীমাতিরিক্ত, বেনামি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শূন্যে নামিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছে এই রোডম্যাপে।
তবে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই রোডম্যাপ কাজে আসবে না বলে মনে করেন আরেক প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তিনি বলেছেন, “ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এর আগেও এরকম রোডম্যাপ ছিলো। আগের রোডম্যাপ থেকে কেন সরে এলাম তা না জেনে নতুন রোডম্যাপ করে কোনও কাজে আসবে না।”
গত শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ব্যাংকিং এলমানাক-এর পঞ্চম সংস্করণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন সাবেক তত্ববধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।
দেশের ব্যাংকিং খাতের বিপর্যস্ত অবস্থার জন্য সংস্কারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেন তিনি। বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং সংস্কারের রোডম্যাপ নতুন কিছু নয়, তবে এটি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা এই খাতকে ব্যথিত করেছে।”
“আমি এর আগে দুটি ব্যাংকিং সংস্কারের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তাই আমি সেগুলো এবং বাস্তবায়ন সম্পর্কে অবগত। কিন্তু প্রভাবশালী গোষ্ঠী ব্যাংকিং আইনে এর অন্তর্ভুক্তি রোধ করেছে। পূর্ববর্তী প্রবিধানে কী অভাব ছিল তা আমরা জানি না, তখন বাস্তবায়ন করা কঠিন ছিল। নতুন রোডম্যাপ বাস্তবায়ন সহজ হবে—এটা আমি মনে করি না।”
কমেন্ট