হেড লাইনস:

ট্রাম্প শুল্কের ধাক্কায় সোনার দরেও ধস     

লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত বাড়ছে

লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত বাড়ছে

তবে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়েই চলেছে, ৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে মাত্র ৮১ কোটি ২০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) উদ্বৃত্ত বেশ খানিকটা বেড়েছে। আর এতে অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তা কেটে যাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ব্যালান্স অব পেমেন্টে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১৪ কোটি ৮০ লাখ (৩.১৫ বিলিয়ন) ডলার।

ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল ১৯২ কোটি ৭০ লাখ (১.৯২ বিলিয়ন) ডলার; পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) উদ্বৃত্ত ছিল ৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) এই সূচকে ৪ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ছিল।

তবে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতি বেড়েই চলেছে, ৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে মাত্র ৮১ কোটি ২০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল।

আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনও অর্থবছরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে এত ঘাটতি দেখা যায়নি।

আমদানি কমায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই ঘাটতি ৩৩৩ কোটি (৩.৩৩ বিলিয়ন) ডলারে নেমে এসে অর্থবছর শেষ হয়েছিল।

২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি ছিল ৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, “সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে পণ্য আমদানি ব্যয় কমেছে। অন্যদিকে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সেও ইতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। সে কারণে চলতি হিসাবে ব্যালান্স অব পেমেন্টে উদ্বৃত্ত বেড়েছে। এতে অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তা কেটে যাওয়ার একটা আভাস পাওয়া যাচ্চে।”

“তবে ডলারসংকট কিন্তু কাটেনি। আমদানি একটু বাড়লেই এই উদ্বৃত্ত আর থাকবে না; ঘাটতি দেখা দেবে। অন্যদিকে আর্থিক হিসাবে এবং সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি কিন্তু বেড়েই চলেছে। আইএমএফ, এডিবি ও কোরিয়া সরকারের ঋণে রিজার্ভ খানিকটা বেড়েছিল। কিন্তু জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ায় এবং সোয়াপ কারেন্সি (টাকা–ডলার অদলবদল) সুবিধা চালুর আওতায় ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা ডলার নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।”

“তবে দু-একদিনের মধ্যে আকুর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের ১ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল শোধ করতে হবে। তখন কিন্তু রিজার্ভ আবার ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে। এই রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।”

“তাই রিজার্ভ যাতে আর না কমে, সেদিকে এখন সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আর সে কারণে রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে হবে। রেমিটেন্স বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতা সংস্থার ঋণগুলোর আরও ঋণ যাতে দ্রুত পাওয়া যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করে। পুরো অর্থবছরে সেই উল্লম্ফন দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়।

ওই অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও উল্লম্ফন হয়েছিল, ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিটেন্স কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। সে কারণেই ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি চূড়ায় উঠেছিল।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “চলতি হিসাবে ব্যালান্স অব পেমেন্টে উদ্বৃত্ত দেখা দিলেও অর্থনীতিতে স্বস্তি কিন্তু ফিরে আসছে না। ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, রিজার্ভ না বাড়লে কিন্তু ডলারের দাম কমবে না। তাই রিজার্ভ বাড়ানোর দিকেই এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে সরকারকে।”

“আমদানি ব্যয় কমিয়ে নয়, রেমিটেন্স, রপ্তানি আয় ও কম সুদের বিদেশি ঋণ বাড়িয়ে রিজার্ভ বাড়তে হবে,” বলেন দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা এই অর্থনীতিবিদ।

বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর।

তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।

বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ৬৫.৪৫ শতাংশ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬২ কোটি ৮০ লাখ (৪.৬৩ বিলিয়ন) ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম।

২০২২-২৩ অর্থবছরের এই সাত মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৩৯ কোটি ৬০ লাখ (১৩.৩৯ বিলিয়ন) ডলার।

জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৩ হাজার ৬০২ কোটি ৬০ লাখ (৩৬.০২ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই সাত মাসে ৪৪ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।

অন্যদিকে জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের এই সাত মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩০ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।

এ হিসাবেই চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ কমে ৪ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এই ঘাটতি ৩৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।

রেমিটেন্স বেড়েছে ৭.৬১ শতাংশ

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ১০২দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।

এরই মধ্যে রেমিটেন্সের ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই মাসে ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সব মিলিয়ে আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রেমিটেন্সের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।

রিজার্ভ ২১.১৫ বিলিয়ন

বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ।

গত বৃহস্পতিবার সবশেষ রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই দিন আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার।

সেবা বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার।

মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি ৪.৬৮ বিলিয়ন ডলার

জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে (ওভারঅল ব্যালান্স) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।

২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ঘাটতি ছিল ৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার।

আর্থিক হিসাবে ঘাটতি .৩৫ বিলিয়ন ডলার

চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে মাত্র ৮১ কোটি ২০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল।

তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এই ঘাটতি ছিল ৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই সূচকে ১৫ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত ছিল।

কোভিড-১৯ অতিমারীর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণ-সহায়তা পাওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত ছিল বলে জানান আহসান মনসুর।

“কিন্তু গত অর্থবছরে দাতাদের ঋণ-সহায়তা বেশ কমে যায়। চলতি অর্থবছরেও সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে,” যোগ করেন মনসুর।

বাণিজ্য ঘাটতি কমলেও আর্থিক হিসাব নিয়ে উদ্বেগ পরবর্তী

বাণিজ্য ঘাটতি কমলেও আর্থিক হিসাব নিয়ে উদ্বেগ

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর