লেনদেন ভারসাম্যের হিসাব হঠাৎ ওলোটপালট

লেনদেন ভারসাম্যের হিসাব হঠাৎ ওলোটপালট

চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে হঠাৎ বড় পরিবর্তন এসেছে; উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর বড় ঘাটতিতে থাকা আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের তথ্য নতুনভাবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এতে ওলোটপালট হয়ে গেছে হিসাব।

চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে হঠাৎ বড় পরিবর্তন এসেছে; উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর বড় ঘাটতিতে থাকা আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার প্রকাশিত বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) হালানাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি এবং আর্থিক হিসাব ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হয়েছে। আগের মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাব ছিল উদ্বৃত্ত এবং ঘাটতিতে ছিল আর্থিক হিসাব।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছি ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।

অর্থবছরের নয় মাস অর্থাৎ জুলাই-মার্চ মাস পর্যন্ত এ চিত্র ছিল উল্টো। ওই নয় মাসে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৯ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।

এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ১০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। এতে দেখা যাচ্ছে, আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি কমেছে ৪৩ দশমিক ৮১ শতাংশ।

অপরদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত কমেছে ৩৭ শতাংশ।

রপ্তানি তথ্যে হিসাবের গরমিল থেকে বের হয়ে এসেছে বাংলাদেশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই হিসাবের ক্ষেত্রে এনবিআরের তথ্যই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে রপ্তানি কমে গেছে।

সমন্বয়ের মাধ্যমে নতুনভাবে হিসাব তৈরি করায় আগের অর্থবছরের হিসাবেও এমন পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “প্রকৃত রপ্তানি কত হচ্ছে, সেই তথ্য ব্যবহার করে আর্থিক হিসাব গণনা শুরু হয়েছে। এনবিআর আর ইপিবি একই রকম রপ্তানি তথ্য ব্যবহার করবে। ফলে রপ্তানি তথ্য নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছিল, তা কেটে যাবে।”

এই বিভ্রান্তি দূর করতে বেশ কিছুদিন ধরে আইএমএফ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছে।

ইপিবির হিসাবে বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি (৪৭.৪৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য। অন্যদিকে এনবিআর হিসাব কষে বলেছে, ওই সময়ে দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

এনবিআরের এই হিসাবকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তিন সংস্থা মিলে গত দুই বছরের রপ্তানি হিসাব চূড়ান্ত করেছে। এতেও এনবিআরের হিসাবকে চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত নিট পোশাক শিল্পমারিকদের সংগঠন বিটিএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, এটাই প্রকৃত তথ্য। প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি দেখিয়ে আসছিল ইপিবি। দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়টি আমরা বলে আসছিলাম।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবই যৌক্তিক। সঠিক হিসাব না দেওয়ায় এত দিন নীতিনির্ধারকদের কাছে ভুল বার্তা গেছে। এতে করে পুরো খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ায় রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসার পার্থক্যও কমে এসেছে। এই সময়ে এ ক্ষেত্রে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬৮ কোটি ডলার। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থে ২৪৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

ফলে জুলাই-এপ্রিল সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থেকে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে।

বৈদেশিক আর্থিক সম্পদ ও দায় বিবেচনায় নিয়ে দেশের আর্থিক হিসাব গণনা করা হয়। এর মধ্যে থাকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ সম্পদ। বিনিয়োগের ধারা (সম্পদ ও দায়), বিনিয়োগের দলিল (ইক্যুইটি, বন্ড, নোটস এবং ঋণ) এই হিসাবের আওতায় আসে।

বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদের প্রথম বছরে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সবশেষ আর্থিক হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরের মার্চে ঘাটতি তৈরি হয়, যা গত মার্চ পর্যন্ত চলে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এত দিন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর রপ্তানি ধরে হিসাব করা হতো। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এ নিয়ে দেশি ও বিদেশি নানা সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এত পণ্য রপ্তানি হয়নি। ফলে আয় বেশি আসার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।

উল্টো চিত্র চলতি হিসাবে

বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানি প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ায় চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে চলে গেছে। ওই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য। এর বিপরীতে দেশে আমদানি হয়েছে মোট ৫ হাজার ২৩৭ কোটি (৫২.৩৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য।

এ হিসাবে বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৮৬৯ কোটি (১৮.৬৯ বিলিয়ন) ডলার। এই দশ মাসে সেবা খাতে ঘাটতি ছিল ৩০৫ কোটি (৩.০৫ বিলিয়ন) ডলার। আর প্রাথমিক আয়ে ঘাটতি হয়েছিল ৩৫৯ কোটি (৩.৫৯ বিলিয়ন) ডলার।

তবে একই সময়ে দেশে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৯১১ কোটি (১৯.১১ বিলিয়ন) ডলার। এতে সব মিলিয়ে ওই সময়ে চলতি হিসাবে ৫৭২ কোটি (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার ঘাটতি তৈরি হয়।

মূলত রপ্তানি তথ্যের হিসাবে ওলট–পালট হওয়ায় বদলে গেছে দেশের লেনদেন ভারসাম্যের চিত্র। ফলে জুলাই-এপ্রিল সময়ের সার্বিক হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৫৫৬ কোটি (৫.৫৬ বিলিয়ন) ডলার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এত দিন রপ্তানির ভুল তথ্য দেখিয়ে হিসাব করা হয়েছে। এটা আগেই ঠিক করে ফেলা উচিত ছিল। এখন বোঝা যাচ্ছে, রপ্তানিকারকেরা কতটা ভালো করছেন। এর মাধ্যমে আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। এটা শুধু গণনার হিসাবে পরিবর্তন। এতে চলতি হিসাব আবার ঘাটতিতে চলে গেছে। অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে আছে।”

তিনি বলেন, “আইএমএফের চাপে সংস্থাগুলো সঠিক তথ্য প্রদান করা শুরু করেছে। ফলে রপ্তানির হিসাব যত বড় করে দেখানো হত, আসলে রপ্তানি এত বেশি নয়। রপ্তানির হিসাব বেশি দেখানোর কারণেই চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত আসত।”

সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি কমেছে

এই দশ মাসে  সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যেও (ওভারঅল ব্যালেন্স) ঘাটতি কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে এ হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের এপ্রিল শেষে যা ছিল ৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে ঘাটতি কমেছে ৩৬ দশমিক ৮১ শতাংশ।

জুলাই-এপ্রিল সময়ে দেশে মোট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এই দশ মাসে মোট এফডিআই এসেছে ৩ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময় যা ছিল ৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার।

আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল পরবর্তী

আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল

কমেন্ট