ঈদকে সামনে রেখে বাড়ছে রেমিটেন্স

ঈদকে সামনে রেখে বাড়ছে রেমিটেন্স

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্সপ্রবাহ বাড়ছে। চলতি জুন মাসের নয় দিনে (১ থেকে ৯ জুন) ৫৭ কোটি ৫৬ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

গত মে মাসে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার এসেছিল; প্রতিদিনের গড় অঙ্ক ছিল ৫ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। মাসের বাকি দিনগুলোতে এ হারে আসলেও ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রেমিটেন্স ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারে গিয়ে পৌঁছবে বলে হিসাব বলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের আগে রেমিটেন্স আরও বাড়বে। মাসের একেবারের শেষ দিকে ঈদ উদযাপিত হবে। তার আগে করোবানির পশু কেনাসহ ঈদের অন্যান্য খরচের জন্য পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি টাকা পাঠাবেন প্রবাসীরা।

সে কারণে জুন মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তারা।

মে মাসে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার (১.৬৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ছিল এপ্রিল মাসের চেয়ে দশমিক ৪ শতাংশ বেশি; তবে গত বছরের মে মাসের চেয়ে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কম ছিল।

এপ্রিল মাসে ১৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত বছরের মে মাসে এসেছিল ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।

গত মার্চ মাসে ২০২ কোটি ২৫ লাখ (২.০২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত বছরের এপ্রিলে এসেছিল ২০১ কোটি ৮ লাখ ডলার।

রোজার মাসে সব সংসারেই বাড়তি খরচ হয়। প্রয়োজনীয় সেই ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি অর্থ দেশে পাঠানোয় মার্চে রেমিটেন্স বেড়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতায় ঈদের মাস এপ্রিলেও রেমিটেন্সপ্রবাহ বাড়বে। কিন্তু ঈদের মাসে রেমিটেন্স না বেড়ে উল্টো কমেছিল। ২২ এপ্রিল দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়।

ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় প্রবাসীরা অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে টাকা না পাঠিয়ে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানোয় ব্যাংকে রেমিটেন্স কমছে বলে ধারণা করছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক, অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। পরের মাস আগস্টে আসে কিছু কম, ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার। এর পরের ছয় মাসের কোনো মাসেই প্রবাসী আয় ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি। মার্চে তা ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) সব মিলিয়ে ১৯ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি।

রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। তবে কার্ব মার্কেটে ডলারের দর ১১২ থেকে ১১৩ টাকা। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠালে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয় সরকার। এর পরও অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠালে প্রতি ডলারে ৩-৪ টাকা বেশি পাওয়া যায়। সে কারণেই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান অনেক প্রবাসী।

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে রেমিটেন্স  কেননা এই সূচকের বাড়া-কমার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে রিজার্ভের উত্থান-পতন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।

তবে বেশ উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর; প্রথম মাস জুলাইয়ে ২১০ কোটি (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠান প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার।

পরের মাস সেপ্টেম্বরে হোঁচট খায়; এক ধাক্কায় নেমে আসে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে। অক্টোবরে তা আরও কমে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে নেমে আসে। পরের তিন মাস টানা বেড়েছে; নভেম্বরে আসে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে আসে ১৭০ কোটি ডলার।

২০২৩ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আসে আরও বেশি, ১৯৬ কোটি ডলার। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা বেশ কমে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলারে নেমে আসে।

রিজার্ভ ২৯.৭৮ বিলিয়ন ডলার

আমদানি ব্যয় কমছেই। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গতিও মন্দ নয়। রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। আইএমএফের পর বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তার ৫০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ রিজার্ভে যোগ হয়েছে। এর পরও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না।

রোববার দিনের শুরুতে রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।

গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। মাঝে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণে ভর করে ৩০ বিলিয়ন ডলারের উপরে উঠেছিল।

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর মে-জুন মেয়াদের আমদানি বিল পরিমোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে।

বাজারে ডলারের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির ফলে রিজার্ভ কমছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাস আট আট দিনে (২০২২ সালে ১ জুলাই থেকে চলতি জুন মাসের ৮ তারিখ) রিজার্ভ থেকে ১ হাজার ৩১১ কোটি (১৩.১১ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

এই অঙ্ক গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, জুলাই-জুন) চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। গত অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কোনো বছর বা অর্থবছরের পুরো সময়েও (১২ মাস) রিজার্ভ থেকে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি।

আমদানি কমায় এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের রেমিটেন্স বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ডলারের দর ধরে রাখতে ২০২০-২১ অর্থবছরে উল্টো বাজার থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ রিজার্ভে যোগ হওয়ার পরও কমছে এই সূচক। এক বছর আগে ৩১ মে রিজার্ভ ছিল ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।

 

রেমিটেন্সে সুখবর নেই, রিজার্ভ কমছেই পরবর্তী

রেমিটেন্সে সুখবর নেই, রিজার্ভ কমছেই

কমেন্ট