২১ দিনেই ১৮ হাজার কোটি টাকা পাঠালেন প্রবাসীরা
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া একটি বড় সংখ্যক শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করেন। ফাইল ছবি
ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে জোয়ার বইছে। ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনের ২১ দিনে ১৬৭ কোটি (১.৬৭ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে প্রায় ৮ কোটি ডলার।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে চলতি মাসের এই ২১ দিনে (১ থেকে ২১ জুন) এসেছে ১৮ হাজার ১২০ কোটি টাকা, প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮৬৩ কোটি টাকা।
২০২২ সালের জুন মাসের এই ২১ দিনে ১১৫ কোটি (১.১৫ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রবাসী আয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আর এই রেমিটেন্সের উপর ভর করেই গত বুধবার বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আবার ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। এই সূচক বাড়ায় রিজার্ভে যে টান পড়েছে, তা অনেকটাই কেটে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারা।
গত মে মাসে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে; প্রতিদিনের গড় অঙ্ক ছিল ৫ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বা ৬১০ কোটি টাকা।
২৯ জুন দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে। তার আগে রেমিটেন্স আরও বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ২১ দিনে যে রেমিটেন্স এসেছে মাসের বাকি দিনগুলোতে এ হারে আসলেও জুন মাসে ২ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন (২৩৮ কোটি) ডলার আসবে বলে হিসাব বলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের আগে রেমিটেন্স আরও বাড়বে। মাসের একেবারের শেষ দিকে ঈদ উদযাপিত হবে। তার আগে করোবানির পশু কেনাসহ ঈদের অন্যান্য খরচের জন্য পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি টাকা পাঠাবেন প্রবাসীরা।
সে কারণে জুন মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আড়াই বিলিয়ন (২৫০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সরোয়ার হোসেন এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “প্রবাসী আয় বাড়ছে। ঈদের বাকি কয়দিনে আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। জুন মাসে রেমিটেন্স আড়াই বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে আমরা করছি। আর এর মধ্য দিয়ে ডলার সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাবে।”
মে মাসের ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স ছিল এপ্রিল মাসের চেয়ে দশমিক ৪ শতাংশ বেশি; তবে গত বছরের মে মাসের চেয়ে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কম ছিল।
এপ্রিল মাসে ১৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত বছরের মে মাসে এসেছিল ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
আগের মাস মার্চে ২০২ কোটি ২৫ লাখ (২.০২ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। গত বছরের এপ্রিলে এসেছিল ২০১ কোটি ৮ লাখ ডলার।
রোজার মাসে সব সংসারেই বাড়তি খরচ হয়। প্রয়োজনীয় সেই ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি অর্থ দেশে পাঠানোয় মার্চে রেমিটেন্স বেড়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতায় ঈদের মাস এপ্রিলেও রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে। কিন্তু ঈদের মাসে রেমিটেন্স না বেড়ে উল্টো কমেছিল। ২২ এপ্রিল দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। পরের মাস আগস্টে আসে কিছু কম, ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার। এর পরের ছয় মাসের কোনো মাসেই প্রবাসী আয় ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি। মার্চে তা ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসে।
বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সব মিলিয়ে ১৯ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। তবে কার্ব মার্কেটে ডলারের দর ১১২ থেকে ১১৩ টাকা। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠালে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয় সরকার। এর পরও অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠালে প্রতি ডলারে ৩-৪ টাকা বেশি পাওয়া যায়। সে কারণেই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান অনেক প্রবাসী।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।
তবে বেশ উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর; প্রথম মাস জুলাইয়ে ২১০ কোটি (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠান প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার।
পরের মাস সেপ্টেম্বরে হোঁচট খায়; এক ধাক্কায় নেমে আসে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে। অক্টোবরে তা আরও কমে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে নেমে আসে। পরের তিন মাস টানা বেড়েছে; নভেম্বরে আসে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে আসে ১৭০ কোটি ডলার।
২০২৩ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আসে আরও বেশি, ১৯৬ কোটি ডলার। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা বেশ কমে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলারে নেমে আসে।
প্রকৃত রিজার্ভ ২৪.৪০ বিলিয়ন ডলার
আমদানি ব্যয় কমছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গতিও ভালো। রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। আইএমএফের পর বিশ্ব ব্যাংকের বাজেট সহায়তার ৫০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ রিজার্ভে যোগ হয়েছে। এর পরও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না।
এখন থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথামতো দেশের রিজার্ভের হিসাব করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সে হিসাবে বর্তমানে রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি হবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
১৮ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় তিনি এ তথ্য দেন।
গভর্নর বলেন, “আইএমএফ সদস্য অন্যান্য দেশগুলো বিপিএম৬-এর ফর্মুলা কার্যকর করেছে। আমরাও সেটা কার্যকর করবো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবও থাকবে। বিপিএম৬-এর ফর্মুলা পালন করলে দেশের রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।”
রউফ তালুকদার বলেন, “আমরা রিজার্ভ থেকে যেসব বিনিয়োগ করেছি সেগুলো ঝুঁকিমুক্ত। আমাদের সব ঋণের গ্যারান্টার রয়েছে। সব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত পাবে। শ্রীলংকার লোনও আমরা ফেরত পেতে পারি তাদের স্থানীয় মুদ্রায় সমন্বয়ের মাধ্যমে।”
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক মোট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করে আসছিল। কিন্তু বেশ কিছুদের ধরে আইএমএফ এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশ ব্যাংক মোট যে রিজার্ভের হিসাব দিচ্ছে, তাতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), শ্রীলঙ্কাতে দেওয়া ২০ কোটি ডলার ঋণসহ অন্য কয়েকটি প্রকল্পে বিনিয়োগকে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হচ্ছে।
আইএমএফ বলছে, এটা রিজার্ভের নিট বা প্রকৃত হিসাব নয়। কেননা, এই মুহূর্তে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ সরকার রিজার্ভ থেকে যে অর্থ অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বা ঋণ দেয়া হয়েছে, তা ব্যবহার করতে পারবে না।
আপৎকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য রিজার্ভের যে অর্থ তাৎক্ষনিক খরচ করা যাবে সেটাকেই রিজার্ভ হিসেবে হিসাব করতে বলে আসছিল আইএমএফ।
এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি আমলে না নিলেও ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ায় আইএমএফের এই শর্তটি এখন বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে সরকারকে।
আইএমএফের ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে মানতে হবে ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) ফর্মুলা।
আর নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সেই কথাটিই বলেছেন।
বিপিএম-৬ ফর্মুলা মেনে হিসাব করলে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ ইডিএফের ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এবং শ্রীলঙ্কার ২০ কোটি ডলার ও অন্য কয়েকটি প্রকল্পে ৮০ কোটি ডলার সব মিলিয়ে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ৩০ বিলিয়ন ডলার থেকে বাদ দিলে আইএমএফের হিসাবে রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলঅর দাঁড়ায়।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আকুর বিল পরিশোধ করতে হবে
গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। মাঝে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণে ভর করে ৩০ বিলিয়ন ডলারের উপরে উঠেছিল।
পরে আবার কমে ২৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গত কয়েকদিনে রেমিটেন্স বাড়ায় আবার ৩০ বিলিয়ন ডলারের উপরে উঠেছে।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর মে-জুন মেয়াদের আমদানি বিল পরিমোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে।
তবে চার দাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি এবং জাইকার সোয়া বিলিয়ন ডলারের ঋণ-সহায়তা এই মাসের মধ্যেই রিজার্ভে যোগ হবে। তখন রিজার্ভ খানিকটা বাড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। গত এপ্রিলে ৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে বর্তমানের নিট রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে চার মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে।
কমেন্ট