২৫ দিনেই ২০০ কোটির বেশি রেমিটেন্স, রিজার্ভ ৩১.১৫ বিলিয়ন ডলার
ফাইল ছবি
সংকটকালে আবারও এগিয়ে এলেন প্রবাসী ভাই-বোনেরা; ঈদের আগে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে বন্যা বইয়ে দিয়েছেন দেশে।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনের ২৫ দিনেই ২০২ কোটি (২.০২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন তারা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮ কোটি শূন্য আট লাখ ডলার।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে চলতি মাসের এই ২৫ দিনে (১ থেকে ২৫ জুন) এসেছে ২১ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা, প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮৭৭ কোটি টাকা।
২০২২ সালের জুন মাসের এই ২৫ দিনে ১৩৩ কোটি (১.৩৩ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই ২৫ দিনে প্রবাসী আয়ে ৫২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আর এই রেমিটেন্সের উপর ভর করে এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক-এআইআইবি এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকার কাছ থেকে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার যোগ হওয়ায় বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
সোমবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে সোমবারও রিজার্ভ থেকে ৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের সোমবার পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
যা গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, জুলাই-জুন) চেয়েও দ্বিগুণ। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে সব মিলিয়ে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশের রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। এই সূচক বাড়ায় রিজার্ভে যে টান পড়েছে, তা অনেকটাই কেটে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
এমনকি ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ জুনের মধ্যে ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার প্রকৃত রিজার্ভ রাখার যে শর্ত দিয়েছিল, বর্তমানে তার চেয়েও বেশি মজুত রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
আইএমএফের ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে মানতে হবে ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) ফর্মুলা।
গত ১৮ জুন নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছেন, এখন থেকে আইএমএফের শর্ত মেনে বিপিএম-৬ ফর্মুলা পদ্ধতিতে রিজার্ভের হিসাব করা হবে। সেই সঙ্গে রিজার্ভের মোট হিসাবও প্রকাশ করা হবে বলে জানান গভর্নর।
বিপিএম-৬ ফর্মুলা মেনে হিসাব করলে বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন ২৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ ইডিএফের (রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল) ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এবং শ্রীলঙ্কার ২০ কোটি ডলার ও অন্য কয়েকটি প্রকল্পে ৮০ কোটি ডলার সব মিলিয়ে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাদ দিলে আইএমএফের হিসাবে প্রকৃত রিজার্ভ ২৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার দাঁড়ায়।
রেমিটেন্স
গত মে মাসে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে; প্রতিদিনের গড় অঙ্ক ছিল ৫ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বা ৬১০ কোটি টাকা।
২৯ জুন দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে। তার আগে রেমিটেন্স আরও বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ২৫ দিনে যে রেমিটেন্স এসেছে মাসের বাকি দিনগুলোতে এ হারে আসলেও জুন মাসে ২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন (২৪২ কোটি) ডলার আসবে বলে হিসাব বলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের আগে রেমিটেন্স আরও বাড়বে। মাসের একেবারের শেষ দিকে ঈদ উদযাপিত হবে। তার আগে করোবানির পশু কেনাসহ ঈদের অন্যান্য খরচের জন্য পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি টাকা পাঠাবেন প্রবাসীরা।
সে কারণে জুন মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আড়াই বিলিয়ন (২৫০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সরোয়ার হোসেন এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “প্রবাসী আয় বাড়ছে। ঈদের বাকি কয়দিনে আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। জুন মাসে রেমিটেন্স আড়াই বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে আমরা করছি। আর এর মধ্য দিয়ে ডলার সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাবে।”
মে মাসের ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স ছিল এপ্রিল মাসের চেয়ে দশমিক ৪ শতাংশ বেশি; তবে গত বছরের মে মাসের চেয়ে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কম ছিল।
এপ্রিল মাসে ১৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত বছরের মে মাসে এসেছিল ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
আগের মাস মার্চে ২০২ কোটি ২৫ লাখ (২.০২ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। গত বছরের এপ্রিলে এসেছিল ২০১ কোটি ৮ লাখ ডলার।
রোজার মাসে সব সংসারেই বাড়তি খরচ হয়। প্রয়োজনীয় সেই ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি অর্থ দেশে পাঠানোয় মার্চে রেমিটেন্স বেড়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতায় ঈদের মাস এপ্রিলেও রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে। কিন্তু ঈদের মাসে রেমিটেন্স না বেড়ে উল্টো কমেছিল। ২২ এপ্রিল দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়।
সব মিলিয়ে বিদায়ী অর্থবছরের সোমবার পর্যন্ত ২১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। পরের মাস আগস্টে আসে কিছু কম, ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার। এর পরের ছয় মাসের কোনো মাসেই প্রবাসী আয় ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি। মার্চে তা ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসে।
বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সব মিলিয়ে ১৯ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। তবে কার্ব মার্কেটে ডলারের দর ১১২ থেকে ১১৩ টাকা। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠালে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয় সরকার। এর পরও অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠালে প্রতি ডলারে ৩-৪ টাকা বেশি পাওয়া যায়। সে কারণেই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান অনেক প্রবাসী।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।
তবে বেশ উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর; প্রথম মাস জুলাইয়ে ২১০ কোটি (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠান প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার।
পরের মাস সেপ্টেম্বরে হোঁচট খায়; এক ধাক্কায় নেমে আসে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে। অক্টোবরে তা আরও কমে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে নেমে আসে। পরের তিন মাস টানা বেড়েছে; নভেম্বরে আসে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে আসে ১৭০ কোটি ডলার।
২০২৩ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আসে আরও বেশি, ১৯৬ কোটি ডলার। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা বেশ কমে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলারে নেমে আসে।
রিজার্ভ ৩১.১৫ বিলিয়ন ডলার
অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে রিজার্ভ। আমদানি ব্যয় কমার পরও রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছিল।
কমতে কমতে ১৫ জুন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে এই সূচক ৪৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উঠে গিয়েছিল; এক বছর আগেও ছিল ৪১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক এবং দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। কমতে কমতে রিজার্ভ উদ্বেগজনক অবস্থায় নেমে এসেছিল। সেখান থেকে ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল খুশির খবর।”
“এখন সরকার কিছুটা স্বস্তি পাবে; সাহস পাবে। চাপ বা সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হবে। তবে আত্মতৃপ্তিতে ভূগলে চলবে না। রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়াতে আরও জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।”
কমেন্ট