তিন বছরে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স জুনে
তিন বছর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় এসেছিল দেশে। যা একক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছিল ওই অর্থবছরের মে মাসে, ২১৭ কোটি ১০ লাখ (২.১৭ বিলিয়ন) ডলার। সদ্য সমাপ্ত জুন মাসে এর চেয়েও বেশি অর্থ ২২০ কোটি (২.২০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, তিন বছর পর এক মাসের হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছে জুন মাসে।
ঈদকে সামনে রেখে কোরবানির পশু কেনাসহ পরিবার-পরিজনের অন্যান্য খরচ মেটাতে বেশি অর্থ পাঠানোয় রেমিটেন্সে এই উল্লম্ফন হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
আর এই রেমিটেন্সের উপর ভর করে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রোববার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার রেমিটেন্স প্রবাহের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সোয়া কোটি প্রবাসী ২১৯ কোটি ৯০ লাখ (২.২০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে জুন মাসেে ২৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী ভাই-বোনেরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে পাঠিয়েছেন ৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার বা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
গত বছরের জুন মাসে ১৮৩ কোটি ৭২ (১.৮৩ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুন মাসে ২০২২ সালের জুনের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে।
আর আগের মাস মে মাসের চেয়ে বেশি এসেছে ৩০ দশমিক ১৮ শতাংশ।
মে মাসে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে; প্রতিদিনের গড় অঙ্ক ছিল ৫ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বা ৬১০ কোটি টাকা।
২৯ জুন দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়। সে কারণে পুরো মাস জুড়েই রেমিটেন্স প্রবাহে ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সরোয়ার হোসেন এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “মূলত ঈদের কারণেই জুন মাসে প্রবাসী আয় বেশ বেড়েছে। এই সময়ে এটার খুব দরকার ছিল। রিজার্ভ বাড়াতে বড় অবদান রেখেছে রেমিটেন্স।”
অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ২.৭৬ শতাংশ
সব মিলিয়ে বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ১৬১ কোটি (২১.৬১ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার এসেছিল।
এপ্রিল মাসে ১৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা আগের মাস মার্চে এসেছিল ২০২ কোটি ২৫ লাখ ডলার।
রোজার মাসে সব সংসারেই বাড়তি খরচ হয়। প্রয়োজনীয় সেই ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি অর্থ দেশে পাঠানোয় মার্চে রেমিটেন্স বেড়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতায় ঈদের মাস এপ্রিলেও রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে। কিন্তু রোজার ঈদের মাসে রেমিটেন্স না বেড়ে উল্টো কমেছিল। ২২ এপ্রিল দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। পরের মাস আগস্টে আসে কিছু কম, ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার। এর পরের ছয় মাসের কোনো মাসেই প্রবাসী আয় ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি। মার্চে তা ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসে।
এপ্রিল-মে দুই মাস কমার পর জুন মাসে এক লাফে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।
তবে বেশ উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর; প্রথম মাস জুলাইয়ে ২১০ কোটি (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠান প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার।
পরের মাস সেপ্টেম্বরে হোঁচট খায়; এক ধাক্কায় নেমে আসে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে। অক্টোবরে তা আরও কমে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে নেমে আসে। পরের তিন মাস টানা বেড়েছে; নভেম্বরে আসে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে আসে ১৭০ কোটি ডলার।
২০২৩ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আসে আরও বেশি, ১৯৬ কোটি ডলার। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা বেশ কমে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলারে নেমে আসে।
রিজার্ভ ৩১.২০ বিলিয়ন ডলার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিরও গুরুত্বপূর্ণ সূচক এখন রিজার্ভ। আমদানি ব্যয় কমার পরও রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছিল।
কমতে কমতে ১৫ জুন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে এই সূচক ৪৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উঠে গিয়েছিল; এক বছর আগেও ছিল ৪১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক এবং দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। কমতে কমতে রিজার্ভ উদ্বেগজনক অবস্থায় নেমে এসেছিল। সেখান থেকে ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানো খুশির খবর।”
“এখন সরকার কিছুটা স্বস্তি পাবে; সাহস পাবে। চাপ বা সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হবে। তবে আত্মতৃপ্তিতে ভূগলে চলবে না। রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়াতে আরও জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।”
তিনি বলেন, “এই সপ্তাহেই আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের) ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন কিন্তু রিজার্ভ ফের ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে।”
রিজার্ভ যাতে কোনো অবস্থাতেই ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে না নামে, সেজন্য, রপ্তানি আয়-রেমিটেন্সের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে কম সুদের ঋণ-সহায়তা পাওয়ার দিকেও জোর প্রচেষ্টা চালানোর জন্য সরকারকে পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
কমেন্ট