জনশক্তি রপ্তানি: ছয় হাজার থেকে দেড় কোটি

জনশক্তি রপ্তানি: ছয় হাজার থেকে দেড় কোটি

৩০ জুন শেষ হওয়া বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ লাখ ৩৭ হাজার জন কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে গেছেন। এই সংখ্যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। ফাইল ছবি

বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। ওই বছর ৬ হাজার ৮৭ জন কর্মী বিদেশে যান। তারপর ইতিহাস! প্রতি বছরই বাড়ছে এই সংখ্যা। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ লাখ ৩৫ হাজার জন কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে গেছেন। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক আর্থিক বছর বা বছরে কাজের সন্ধানে এত লোক বিদেশে যাননি। দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে জনশক্তি রপ্তানিতে নতুন মাইলফলক গড়েছে বাংলাদেশ। 

সব মিলিয়ে বর্তমানে দেড় কোটি প্রবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন। আর তাদের পাঠানো রেমিটেন্সে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। 

গত ৫ জুলাই জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বের ১৭৬টি দেশে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সুশৃঙ্খল, নিরাপদ ও দায়িত্বশীল শ্রম অভিবাসন নিশ্চিতে নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার। বর্তমানে বিশ্বের ১৭৬টি দেশে এক কোটি ৪৯ লাখের অধিক কর্মী কর্মরত।”  

বর্তমান সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর বিগত এক যুগে পেশাজীবী, দক্ষ, আধাদক্ষ ও স্বল্পদক্ষ ক্যাটাগরিতে ৮১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৪২ জনের বৈদেশিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। 

বিশ্বব্যাংকের হিসেবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় উপার্জনে বিশ্বে ৮ম অবস্থানে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটা বড় উৎস হল এই রেমিটেন্স। যার বড় একটা অংশ আসে মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এছাড়া প্রবাসী আয় থেকে যোগ হয় দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। 

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ লাখ ৩৭ হাজার জন কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে গেছেন। এই সংখ্যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। 

২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ লাখ ৮৮ হাজার জন কাজের সন্ধানে বিদেশে গিয়েছিলেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল খুবই কম, ২ লাখ ৮০ হাজার; করোনা মহামারির কারণে প্রায় সব দেশে লকডাউন থাকায় ওই অর্থবছরে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নেমেছিল।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ লাখ ৯৮ হাজার জন জনশক্তি রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। তার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৫৯ হাজার। 

২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হলে লকডাউন ও বিধিনিষেধের কারণে অভিবাসন থমকে গিয়েছিল একেবারেই। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকলে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে শ্রম অভিবাসন। এরপর থেকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী পাঠানোর প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় রয়েছে। 

পাল্লা দিয়ে আসছে না রেমিটেন্স 

তবে জনশক্তি রপ্তানিতে মাইলফলক অর্জন করলেও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স বাড়ছে না। করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। 

কিন্তু পরের বছরগুলোতে রেমিটেন্স প্রবাহে সেই উল্লম্ফন আর দেখা যাচ্ছে না। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিটেন্স কমে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে অবশ্য ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেড়ে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে। 

জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিটেন্স কেন বাড়ছে না-এ প্রশ্নের উত্তরে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এই যে আমরা সাড়ে ১১ লাখ লোককে বিদেশে পাঠালাম, এটি একটি বিশাল বড় ঘটনা। কিন্তু দুঃখজনক হলো জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিটেন্স বাড়ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে হুন্ডি। করোনা মহামারির কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় বিশ্বব্যাপী অবৈধ হুন্ডি কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। সে কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। ওই অর্থবছরে প্রবাসীরা সব অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছিলেন।” 

“কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই ফের হুন্ডি কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে। ডলারের বাজারের অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে যারা বিভিন্ন দেশে গেছেন, তারা বেশিরভাগ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। বেতন পাচ্ছেন; দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন। সে হিসাবে রেমিটেন্সের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না; উল্টো কমছে। এটি একটি উদ্বেগের বিষয়। এই রেমিটেন্স কমার কারণেই কিন্তু আমাদের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমে আসছে।”

আবুল বাশার বলেন, ‘এখানে প্রবাসী ভাই-বোনদের কোনো দোষ আমি দেখি না। তারা প্রতি ডলারে চার-পাঁচ টাকা বেশি পাচ্ছেন বলেই ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক হুন্ডি বন্ধে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। 

“এখানে সরকারের কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে বা বৈধপথে টাকা পাঠালে সরকার এখন যে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। তা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করলে হুন্ডি বন্ধ হবে বলে আমি মনে করি।’ 

তবে ভিন্ন কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। 

তিনি এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “প্রণোদনা দিয়ে রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা কখনই ধরে রাখা যাবে না। হুন্ডি বন্ধ করতেই তো সরকার প্রথমে ২ শতাংশ, পরে তা আরও বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। কিন্তু হুন্ডি তো বন্ধ হচ্ছে না; উল্টো আরও বাড়ছে। এখানে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো, ডলারের বাজারকে স্থিতিশীল করতে হবে। কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। যত এই পার্থক্য বেশি থাকবে ততো দিন হুন্ডি বন্ধ হবে না।” 

আহসান মনসুর বলেন, ‘খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দর এখন ১১২ থেকে ১১৩ টাকা। ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা পাওয়া যায়। তার সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হয়ে পাওয়া যায় ১১০ টাকার কিছু বেশি। ব্যাংকগুলো ১১৪/১১৫ টাকা দরেও রেমিটেন্স সংগ্রহ করছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।” 

“এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠালে, যার নামে পাঠান তিনি ১১৫ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন। অর্থাৎ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠালে যা পেতেন, তার চেয়ে ৫ টাকা বেশি পাচ্ছেন। তাহলে কেন কোনো প্রবাসী তার পরিবার-পরিজনের কাছে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাবেন।” 

 এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে জানান আহসান মনসুর। 

বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, "আমরা এবার ১১ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে পাঠাতে পেরেছি, এটি নিঃসন্দেহে ভালো খবর। তবে আমরা এতে সন্তুষ্ট নই। আমরা যদি প্রতি বছর কমপক্ষে ১৫ লাখ লোক পাঠাতে পারি, তবে এটি বেকারত্ব দূর করতে এবং রেমিট্যান্স বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে।" 

“এটি সম্ভব। আমরা যদি আরও দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারি। আমরা যদি অভিবাসন প্রত্যাশীদের কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি ইংরেজি ও আরবি শেখাতে পারি, তাহলে আমরা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষ শ্রমবাজারটা আরও ভালোভাবে ধরতে পারবো।"

“তখন ৩০/৩৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসবে,” বলেন নোমান।

২১ দিনেই ১৫ হাজার কোটি টাকা পাঠালেন প্রবাসীরা পরবর্তী

২১ দিনেই ১৫ হাজার কোটি টাকা পাঠালেন প্রবাসীরা

কমেন্ট