আগস্টেও রেমিটেন্সে ধীরগতি, ১১ দিনে এসেছে ৬৯ কোটি ডলার
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের ১১ দিনে ৬৯ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। মাসের বাকি দিনগুলোতে এই হারে আসলে, জুলাই মাসের মতো আগস্টেও ২ বিলিয়ন ডলারের কম রেমিটেন্স আসবে বলে হিসাব বলছে।
রেমিটেন্সে সুখবর নেই। দফায় দফায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানোর পরও বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে না। অবৈধ হুন্ডি বন্ধ না হওয়ার কারণেই ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কম আসছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের ১১ দিনে ৬৯ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। মাসের বাকি দিনগুলোতে এই হারে আসলে, জুলাই মাসের মতো আগস্টেও ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের কম রেমিটেন্স আসবে বলে হিসাব বলছে।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৯ টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে এই ১১ দিনে ( ১ থেকে ১১ আগস্ট) ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসী ভাই-বোনেরা; প্রতিদিনের গড় হিসাবে পাঠিয়েছেন ৬ কোটি ৩১ লাখ ডলার বা ৬৮৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
মাসের বাকি ২০ দিনে (১২ থেকে ৩১ আগস্ট) এই হারে রেমিটেন্স আসলে মাস শেষে মোট রেমিটেন্সের অঙ্ক দাঁড়াবে ১৯৫ কোটি ৮৫ লাখ (১.৯৬ বিলিয়ন) ডলার।
যা হবে আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং গত বছরের আগস্টের চেয়ে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আর গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার। প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ (২.১০ বিলিয়ন) ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই ও আগস্ট) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ বিলিয়ন ডলারের কম এসেছে। ১১ দিনে যে হারে এসেছে, সেই হারে আসলে আগস্ট মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের কম প্রবাসী আয় দেশে আসবে।
গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন (২২০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। যা ছিল একক মাসের হিসবে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ; তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
এই হিসাব বলছে, বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক ধারা নিয়েই ২০২৩-২৪ অর্থবছর শুরু হলো।
প্রতিবারই দুই ঈদের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ২৯ জুন দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়। সে কারণে জুন মাসে রেমিটেন্স প্রবাহে উল্লম্ফন দেখা যায়।
ঈদের পরের মাস জুলাইয়ে রেমিটেন্স ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কিন্তু আগস্ট মাসেও সেই ধীরগতি দেখা দেওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “গত কয়েক মাসে রেমিটেন্সে ডলারের দর ধারাবাহিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। সবশেষ ১০৯ টাকা করা হয়েছে। এরপরও অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স আসছে।”
সে কারণেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স কম আসছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি আগস্ট মাসের ১১ দিনে ৬৯ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার ডলারের যে রেমিটেন্স এসেছে, তার মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১ কোটি ৩৯ লাখ ডলার।
৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫৯ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। আর ৯টি বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ১৬১ কোটি (২১.৬১ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার এসেছিল।
রিজার্ভ কমছেই, এক মাসে কমেছে ৪৪ কোটি ডলার
রেমিটেন্সের ধীরগতির কারণে রিজার্ভও কমছে। রেমিটেন্স বাড়ায় ঈদের আগে রিজার্ভ বেড়ে ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।
কিন্তু জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ আবার ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
এরপর থেকে কমছেই। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। তবে এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভ। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।
আর এক মাস আগে ১২ জুলাই ‘গ্রস’ রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
এই হিসাবে ‘গ্রস’ হিসাবে এই এক মাসে রিজার্ভ কমেছে ৪৪ কোটি ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ কমেছে ৩১ কোটি ডলার।
সবশেষ গত জুনে মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
আমদানি খাতে ব্যয় কমার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে। জ্বালানি তেল, সার, খাদ্যপণ্যসহ সরকারের অন্যান্য আমদানি খরচ মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণেই রিজার্ভ কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
আগামী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
দুই মাস পর পর আকুর দেনা পরিশোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ১২ জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাব করতে বাংলাদেশ সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিল।
কিন্তু বাংলাদেশ সে বিষয়টি আমলে নেয়নি। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি সামাল দিতে গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ।
ঋণ সমঝোতার পর আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শ আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
বাাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের সেই শর্ত বা পরামর্শ মেনেই এক মাস ধরে রিজার্ভের দুই ধরনের তথ্যই প্রকাশ করছে।
কমেন্ট