রেমিটেন্স কমছে, ২৫ দিনে এলো ১৩২ কোটি ডলার

রেমিটেন্স কমছে, ২৫ দিনে এলো ১৩২ কোটি ডলার

অবৈধ হুন্ডি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কম আসছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ব্যাংকাররা। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দর বাড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন তারা।

রেমিটেন্সে সুখবর নেই। দফায় দফায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ানোর পরও বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে না।

অবৈধ হুন্ডি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কম আসছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ব্যাংকাররা। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দর বাড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন তারা।

রোববার কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১১৭ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছিল ১১৮ টাকায়।

ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠালে আড়াই শতাংশ প্রণোদনাসহ যা পাওয়া যায়, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে তার চেয়েও ৫/৬ টাকা বেশি পাওয়া যায়। সে কারণেই সবাই হুন্ডির দিকে ঝুঁকছে বলে জানিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের ২৫ দিনে ১৩২ কোটি ৩০ লাখ (১.৩২ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। মাসের বাকি ছয় দিনে (২৬ থেকে ৩১ আগস্ট) এই হারে আসলে, মাস শেষে ১৬৪ কোটি (১.৬৪ বিলিয়ন) ডলার আসবে। যা হবে ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।

গত ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি (১.৫৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৯ টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে চলতি মাসের ২৫ দিনে (১ থেকে ২৫ আগস্ট) ১৪ হাজার ৪২০ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে পাঠিয়েছেন ৫ কোটি ২৯ লাখ ডলার বা ৫৭৭ কোটি টাকা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলার বা ৬৯৪ কোটি টাকা।

আর গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার। প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ (২.১০ বিলিয়ন) ডলার।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই ও আগস্ট) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।

কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ বিলিয়ন ডলারের কম এসেছে। ২৫ দিনে যে হারে এসেছে, সেই হারে আসলেও আগস্ট মাসে দে বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি প্রবাসী আয় দেশে আসবে।

গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন (২২০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। যা ছিল একক মাসের হিসবে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ; তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।      

এই হিসাব বলছে, অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক ধারা নিয়েই ২০২৩-২৪ অর্থবছর শুরু হচ্ছে।

প্রতিবারই দুই ঈদের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ২৯ জুন দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়। সে কারণে জুন মাসে রেমিটেন্স প্রবাহে উল্লম্ফন দেখা যায়।

ঈদের পরের মাস জুলাইয়ে রেমিটেন্স কমাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করছিলেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। কিন্তু আগস্ট মাসেও রেমিটেন্স কমায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “গত কয়েক মাসে রেমিটেন্সে ডলারের দর ধারাবাহিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। সবশেষ ১০৯ টাকা করা হয়েছে। এরপরও অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স আসছে।”

সে কারণেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স কম আসছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিটেন্স কেন বাড়ছে না-এ প্রশ্নের উত্তরে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “গত অর্থবছর আমরা সাড়ে ১১ লাখ লোককে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছি। এটি একটি বিশাল বড় ঘটনা। কিন্তু দুঃখজনক হলো জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিটেন্স বাড়ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে হুন্ডি।”

“করোনা মহামারির কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় বিশ্বব্যাপী অবৈধ হুন্ডি কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। সে কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। ওই অর্থবছরে প্রবাসীরা সব অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছিলেন।”

“কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই ফের হুন্ডি কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে। ডলারের বাজারের অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে যারা বিভিন্ন দেশে গেছেন, তারা বেশিরভাগ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। বেতন পাচ্ছেন; দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন।

“সে হিসাবে রেমিটেন্সের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না; উল্টো কমছে। এটি একটি উদ্বেগের বিষয়। এই রেমিটেন্স কমার কারণেই কিন্তু আমাদের বিদেশি রিজার্ভ কমে আসছে।”

আবুল বাশার বলেন, ‘এখানে প্রবাসী ভাই-বোনদের কোনো দোষ আমি দেখি না। তারা প্রতি ডলারে পাঁচ-ছয় টাকা বেশি পাচ্ছেন বলেই ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক হুন্ডি বন্ধে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।

“এখানে সরকারের কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে বা বৈধপথে টাকা পাঠালে সরকার এখন যে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। তা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করলে হুন্ডি বন্ধ হবে বলে আমি মনে করি।’

তবে ভিন্ন কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রণোদনা দিয়ে রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা কখনই ধরে রাখা যাবে না। হুন্ডি বন্ধ করতেই তো সরকার প্রথমে ২ শতাংশ, পরে তা আরও বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। কিন্তু হুন্ডি তো বন্ধ হচ্ছে না; উল্টো আরও বাড়ছে।”

“এখানে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো, ডলারের বাজারকে স্থিতিশীল করতে হবে। কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। যত দিন এই পার্থক্য বেশি থাকবে তত দিন হুন্ডি বন্ধ হবে না।”

আহসান মনসুর বলেন, ‘খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দর এখন ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা। ব্যাংকের মাধ্যমে ১ ডলার পাঠালে ১০৯ টাকা পাওয়া যায়। তার সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হয়ে পাওয়া যায় ১১১ টাকার কিছু বেশি।”

“আর হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠালে, যার নামে পাঠান তিনি ১২০ টাকার মত পাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কেন কোনো প্রবাসীরা তার পরিবার-পরিজনের কাছে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাবেন।”

এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে জানান আহসান মনসুর।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ১৬১ কোটি (২১.৬১ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। 

২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার এসেছিল।

হুন্ডি বাড়ায় কমছে রেমিটেন্স পরবর্তী

হুন্ডি বাড়ায় কমছে রেমিটেন্স

কমেন্ট