রেমিটেন্স কমছেই, কারণ হুন্ডি
চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সাত দিনে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৫ কোটি ২৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের নিম্মমূখী ধারা অব্যাহত রয়েছে।
চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সাত দিনে (১ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৫ কোটি ২৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে এই সাত দিনে এসেছে ৪ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। প্রতিদিনেএসেছে ৫৭৭ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
গত ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি (১.৫৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
চলতি মাসের সাত দিনে যে রেমিটেন্স এসেছে, মাসের বাকি ২৩ দিনে সেই হারে রেমিটেন্স আসলে মাস শেষে মোট রেমিটেন্সের অঙ্ক ১৫৮ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকবে।
সে হিসাবে আগস্টের চেয়েও সেপ্টেম্বরে কম রেমিটেন্স আসবে।
দফায় দফায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ানোর পরও রেমিটেন্স বাড়ছে না; উল্টো কমছে। অবৈধ হুন্ডি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কম আসছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ব্যাংকাররা।
কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দর বাড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন তারা।
ভয়-আতঙ্কে সোমবার কার্ব মার্কেটে ডলার বেচাকেনা বন্ধই ছিল বলা যায়। খুবই গোপনে দু-একটা লেনদেনের খবর পাওয়া গেছে; প্রতি ডলার ১১৭ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
গত তিন সপ্তাহ ধরে খোলাবাজারে ১১৬ থেকে ১১৮ টাকায় ডলার কেনাবেচা হচ্ছে।
ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠালে আড়াই শতাংশ প্রণোদনাসহ যা পাওয়া যায়, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে তার চেয়েও ৫/৬ টাকা বেশি পাওয়া যায়। সে কারণেই সবাই হুন্ডির দিকে ঝুঁকছে বলে জানিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলার বা ৬৯৪ কোটি টাকা।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ (২.১০ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার।
গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই ও আগস্ট) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ বিলিয়ন ডলারের কম এসেছে। আগস্টে এসেছে, দেড় বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন (২২০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। যা ছিল একক মাসের হিসবে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ; তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
এই তথ্য বলছে, অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রেমিটেন্স প্রবাহে বড় ধাক্কা খেয়েছে। আর এ কারণেই রিজার্ভ কমছেই।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ ২১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৭ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে।
সবশেষ গত জুনে মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে চার মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
গত বৃহস্পতিবার আকুর ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ থেকে তা সমন্বয় করার পর রিজার্ভ কমেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “রিজার্ভ থেকে আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এরপর গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে।”
গত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ওই দিন ‘গ্রস’রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত দুই মাসে ‘গ্রস’রিজার্ভ কমেছে ২ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি খাতে ব্যয় কমার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে। জ্বালানি তেল, সার, খাদ্যপণ্যসহ সরকারের অন্যান্য আমদানি খরচ মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণেই রিজার্ভ কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। এই রেমিটেন্স বাড়ায় কোরবানির ঈদের আগে ‘গ্রস’ রিজার্ভ বেড়ে ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।
কিন্তু জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ আবার ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর থেকে কমছেই।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। মহাসংকটে পড়ায় শ্রীলঙ্কা অবশ্য আকুর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগস্ট মাসে গত বছরের আগস্টের চেয়ে ২১ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম রেমিটেন্স দেশে এসেছে। আর আগের মাস জুলাইয়ের কম এসেছে ১৯ শতাংশ।
জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিটেন্স কেন বাড়ছে না-এ প্রশ্নের উত্তরে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “গত অর্থবছর আমরা সাড়ে ১১ লাখ লোককে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছি। এটি একটি বিশাল বড় ঘটনা। কিন্তু দুঃখজনক হলো জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিটেন্স বাড়ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে হুন্ডি।”
“করোনা মহামারির কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় বিশ্বব্যাপী অবৈধ হুন্ডি কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। সে কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। ওই অর্থবছরে প্রবাসীরা সব অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছিলেন।
“কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই ফের হুন্ডি কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে। ডলারের বাজারের অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে যারা বিভিন্ন দেশে গেছেন, তারা বেশিরভাগ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। বেতন পাচ্ছেন; দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন।
“সে হিসাবে রেমিটেন্সের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না; উল্টো কমছে। এটি একটি উদ্বেগের বিষয়। এই রেমিটেন্স কমার কারণেই কিন্তু আমাদের বিদেশি রিজার্ভ কমে আসছে।”
আবুল বাশার বলেন, “এখানে প্রবাসী ভাই-বোনদের কোনো দোষ আমি দেখি না। তারা প্রতি ডলারে পাঁচ-ছয় টাকা বেশি পাচ্ছেন বলেই ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক হুন্ডি বন্ধে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।
“এখানে সরকারের কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে বা বৈধপথে টাকা পাঠালে সরকার এখন যে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। তা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করলে হুন্ডি বন্ধ হবে বলে আমি মনে করি।”
তবে ভিন্ন কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রণোদনা দিয়ে রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা কখনই ধরে রাখা যাবে না। হুন্ডি বন্ধ করতেই তো সরকার প্রথমে ২ শতাংশ, পরে তা আরও বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। কিন্তু হুন্ডি তো বন্ধ হচ্ছে না; উল্টো আরও বাড়ছে।”
“এখানে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো, ডলারের বাজারকে স্থিতিশীল করতে হবে। কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। যত দিন এই পার্থক্য বেশি থাকবে তত দিন হুন্ডি বন্ধ হবে না।”
আহসান মনসুর বলেন, “খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দর এখন ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা। ব্যাংকের মাধ্যমে ১ ডলার পাঠালে ১০৯ টাকা পাওয়া যায়। তার সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হয়ে পাওয়া যায় ১১১ টাকার কিছু বেশি।”
“আর হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠালে, যার নামে পাঠান তিনি ১২০ টাকার মত পাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কেন কোনো প্রবাসীরা তার পরিবার-পরিজনের কাছে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাবেন।”
এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে জানান আহসান মনসুর।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ১৬১ কোটি (২১.৬১ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার এসেছিল।
কমেন্ট