সাড়ে তিন বছরে সবচেয়ে কম রেমিটেন্স সেপ্টেম্বরে

সাড়ে তিন বছরে সবচেয়ে কম রেমিটেন্স সেপ্টেম্বরে

২০২০ সালের এপ্রিলে ১০৯ কোটি ২৯ লাখ (১.০৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এর পর গত সাড়ে তিন বছরে সেপ্টেম্বরের মতো এত কম রেমিটেন্স দেশে আসেনি।

বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ধস নেমেছে।

সদ্য শেষ হওয়া সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ (১.৩৬ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। একক মাসের হিসাবে এই রেমিটেন্স সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

২০২০ সালের এপ্রিলে ১০৯ কোটি ২৯ লাখ (১.০৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এর পর গত সাড়ে তিন বছরে সেপ্টেম্বরের মতো এত কম রেমিটেন্স দেশে আসেনি।

২০২০ সালের প্রথম দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশে দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় লকডাউন; সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়।

কমতে শুরু করে রেমিটেন্স। সেই ধাক্কায় ২০২০ সালের মার্চে রেমিটেন্স ১২৭ কোটি ৬২ লাখ ডলারে নেমে আসে। এপ্রিলে তা আরও কমে ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলারে নেমে আসে।

এর পর থেকে অবশ্য রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়তে থাকে।

রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১১০ টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে সেপ্টেম্বরে ১৪ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা এসেছে। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৪৯২ কোটি টাকা।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিন এসেছিল ৫৬৭ কোটি টাকা।

অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ ৬৯৪ কোটি টাকা।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স দেশে এসেছিল।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই সেপ্টেম্বরে গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে রেমিটেন্স কমেছে ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর আগস্টের চেয়ে কমেছে ১৬ শতাংশ।

৩ মাসে কমেছে ১৩.৩৩ শতাংশ

বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার রেমিটেন্স প্রবাহের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, তিন মাসের হিসাবে অর্থাৎ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৪৯১ কোটি ৬৩ লাখ (৪.৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

গত বছরের একই সময়ে পাঠিয়েছিলেন ৫৬৭ কোটি ২৮ লাখ (৫.৬৭ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবাসী আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

হুন্ডি বাড়ায় কমছে রেমিটেন্স

দফায় দফায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ানোর পরও রেমিটেন্স বাড়ছে না; উল্টো কমছে। অবৈধ হুন্ডি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স কম আসছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ব্যাংকাররা।

কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দর বাড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন তারা।

ভয়-আতঙ্কে রোববার কার্ব মার্কেটে ডলার বেচাকেনা বন্ধই ছিল বলা যায়। খুবই গোপনে কিছু লেনদেনে হয়েছে। প্রতি ডলার ১১৭ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

এক মাসের বেশি সময় ধরে খোলাবাজারে ১১৬ থেকে ১১৮ টাকায় ডলার কেনাবেচা হচ্ছে।

ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠালে আড়াই শতাংশ প্রণোদনাসহ যা পাওয়া যায়, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে তার চেয়েও ৫/৬ টাকা বেশি পাওয়া যায়।

সে কারণেই সবাই হুন্ডির দিকে ঝুঁকছে বলে জানিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের যে রেমিটেন্স এসেছে। এর মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১১ কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩ কোটি ৫১ লাখ ডলার।

৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১১৮ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার। আর ৯টি বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫০ লাখ ৬০ হাজার ডলার।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ১৬১ কোটি (২১.৬১ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। 

২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার এসেছিল।

যে করেই হোক হুন্ডি বন্ধ করতে হবে

রেমিটেন্সে ধস নেমেছে কেনো-এ প্রশ্নের উত্তরে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “গত অর্থবছরে আমরা সাড়ে ১১ লাখ লোককে বিদেশে পাঠিয়েছি। এটি একটি বিশাল বড় ঘটনা। কিন্তু দুঃখজনক হলো জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিটেন্স বাড়ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে হুন্ডি।”

“করোনা মহামারির কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় বিশ্বব্যাপী অবৈধ হুন্ডি কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। সে কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। ওই অর্থবছরে প্রবাসীরা সব অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছিলেন।”

“কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই ফের হুন্ডি কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে। ডলারের বাজারের অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে যারা বিভিন্ন দেশে গেছেন, তারা বেশিরভাগ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। বেতন পাচ্ছেন; দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন।

“সে হিসাবে রেমিটেন্সের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না; উল্টো কমছে। এটি একটি উদ্বেগের বিষয়। এই রেমিটেন্স কমার কারণেই কিন্তু আমাদের রিজার্ভ কমে আসছে।”

আবুল বাশার বলেন, “এখানে প্রবাসী ভাই-বোনদের কোনো দোষ আমি দেখি না। তারা প্রতি ডলারে পাঁচ-ছয় টাকা বেশি পাচ্ছেন বলেই ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক হুন্ডি বন্ধে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।

“এখানে সরকারের কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে বা বৈধপথে টাকা পাঠালে সরকার এখন যে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। তা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করলে হুন্ডি বন্ধ হবে বলে আমি মনে করি।”

তবে ভিন্ন কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

তিনি এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “প্রণোদনা দিয়ে রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা কখনই ধরে রাখা যাবে না। হুন্ডি বন্ধ করতেই তো সরকার প্রথমে ২ শতাংশ, পরে তা আরও বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। কিন্তু হুন্ডি তো বন্ধ হচ্ছে না; উল্টো আরও বাড়ছে।”

“এখানে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো, ডলারের বাজারকে স্থিতিশীল করতে হবে। কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। যতো দিন এই পার্থক্য বেশি থাকবে ততো দিন হুন্ডি বন্ধ হবে না।”

আহসান মনসুর বলেন, ‘খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দর এখন ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা। ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে ১১০ টাকা পাওয়া যায়। তার সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হয়ে পাওয়া যায় ১১২ টাকা টাকা ৫০ পয়সা কিছু বেশি।

“এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠালে, যার নামে পাঠান তিনি ১১৮ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন। অর্থাৎ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠালে যা পেতেন, তার চেয়ে ৫/৬ টাকা বেশি পাচ্ছেন। তাহলে কেন কোনো প্রবাসী তার পরিবার-পরিজনের কাছে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাবেন।”

 এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে জানান আহসান মনসুর।

এক মাসে রিজার্ভ কমছে ২ বিলিয়ন ডলার

এদিকে রেমিটেন্স কমায় রিজার্ভ কমছেই। রোববার দিনের শুরুতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৭ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারে।

গত ৫ সেপ্টেম্বর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৯ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

 এ হিসাবে এক মাসে বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ২ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে কমেছে ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার।

রেমিটেন্স বাড়াতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চান অর্থমন্ত্রী পরবর্তী

রেমিটেন্স বাড়াতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চান অর্থমন্ত্রী

কমেন্ট