নভেম্বরেও রেমিটেন্সে উল্লম্ফন, ১০ দিনেই এলো ৭৯ কোটি ডলার
ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনায় রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে আশার আলো দেখা দিয়েছে। অক্টোবরের পর নভেম্বরেও রেমিটেন্স বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ৭৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭ কোটি ৯৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার।
মাসের বাকি ২০ দিনে (১১ থেকে ৩০ নভেম্বর) এই হারে আসলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২৩৮ কোটি ৩২ লাখ (২.৩৮ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে ঠেকবে। যা হবে একক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।
২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (প্রায় ২.৬০ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
প্রণোদনার বাইরে প্রতি ডলার রেমিটেন্সে এখন ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে এই ১০ দিনে ৮ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা দেশে এসেছে। প্রতি দিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮৭৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনায় রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে সরকারের বিদ্যমান প্রণোদনার বাইরে গত ২২ অক্টোবর থেকে আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
সরকার রেমিটেন্সে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে ২ টাকা ৫০ পয়সা বা আড়াই টাকা যোগ করে তার পরিবার-পরিজনকে (যার নামে প্রবাসী টাকা পাঠান) ১০২ টাকা ৫০ পয়সা দেওয়া হয়।
২২ অক্টোবর থেকে ১০২ টাকা ৫০ পয়সার সঙ্গে আরও আড়াই টাকা অর্থাৎ মোট ১০৫ টাকা পাবেন।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এখন কোনো প্রবাসী ১ ডলার দেশে পাঠালে, যার নামে পাঠান তিনি ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন।
সে হিসাবে নভেম্বরের ১০ দিনে (১ থেকে ১০ নভেম্বর) ৯ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা দেশে এসেছে; প্রতিদিন এসেছে ৯১৭ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬৯৪ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় মাস আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল; প্রতিদিন এসেছিল ৫৬৭ কোটি টাকা।
তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স প্রবাহে ধস নামে; আসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৪৮৯ কোটি টাকা।
তবে চতুর্থ মাস অক্টোবরে রেমিটেন্স প্রবাহে উল্লম্ফন দেখা যায়; আসে ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (প্রায় ২ বিলিয়ন) ডলার। প্রতিদিনের গড় হিসাবে আসে ৭০১ কোটি টাকা।
অক্টোবরের রেমিটেন্স ছিল চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। আগের মাস সেপ্টেম্বরের চেয়ে বেশি ছিল ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, নভেম্বরে বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের মাধ্যমে ৭২ কোটি ৩২ লাখ ৬০ হাজার ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৪ কোটি ৯২ লাখ ৪০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
এর বাইরে ৯টি বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার রেমিটেন্স দেশে এনেছে।
তার পরও রিজার্ভ কমছে
রেমিটেন্সে বাড়লেও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে।
গত ৭ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
সবশেষ গত আগস্ট মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। তার আগে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) নিম্মমূখী।
এ পরিস্থিতিতে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ না পাওয়া পর্যন্ত রিজার্ভ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে কিন্তু চার মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আমদানি বেড়ে যদি ৬ বিলিয়ন হয়, তাহলে কিন্তু ৩ মাসের কিছু বেশি সময়ের খরচ মিটবে। তার মানে আমাদের রিজার্ভ কিন্তু উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে।”
“রিজার্ভ যেনো আর না কমে—সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমরা বার বার সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিলাম। গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেও অনুরোধ করেছিলাম।”
কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। রিজার্ভ কমছেই। প্রকৃত রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারে নামা কিন্তু একটি স্পর্শকাতর মানদণ্ড।”
“তবে আমি আগেও বলেছি; এখনও বলছি—প্রণোদনা বাড়িয়ে রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা বেশি দিন ধরে রাখা রাখা যাবে না। সত্যিকার অর্থে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স বাড়াতে হলে হুন্ডি বন্ধ করতে হবে।”
কমেন্ট