রেমিটেন্সে সুবাতাস, ১৭ দিনে এসেছে ১১৯ কোটি ডলার
আহসান এইচ মনসুর বলেন, “প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে কিন্তু চার মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আমদানি বেড়ে যদি ৬ বিলিয়ন হয়, তাহলে কিন্তু ৩ মাসের কিছু বেশি সময়ের খরচ মিটবে। তার মানে আমাদের রিজার্ভ কিন্তু উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে।”
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে সুবাতাস দেখা দিয়েছে। অক্টোবরের পর নভেম্বরেও রেমিটেন্স বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১৭ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ১১৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি। গত বছর এই ১৭ দিনে এসেছিল ১০০ কোটি ডলার ।
তবে রেমিটেন্স বাড়লেও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে।
বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মাসের শুরুতে প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম ১২৩-১২৪ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ফলে বৈধ পথে (ব্যাংকিং চ্যানেল) প্রবাসী আয় পাঠানো বেড়ে গেছে। এখন অবশ্য কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এতে রেমিটেন্স আবার কমতে পারে।
নভেম্বরের প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭ কোটি ডলার।
মাসের বাকি ১৩ দিনে (১৮ থেকে ৩০ নভেম্বর) এই হারে আসলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২১০ কোটি (২.১০ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে ঠেকবে।
প্রণোদনার বাইরে প্রতি ডলার রেমিটেন্সে এখন ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে এই ১৭ দিনে ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা দেশে এসেছে। প্রতি দিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭৭৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনাতেও রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়ে বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে সরকারের বিদ্যমান প্রণোদনার বাইরে গত ২২ অক্টোবর থেকে আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
সরকার রেমিটেন্সে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে ২ টাকা ৫০ পয়সা বা আড়াই টাকা যোগ করে তার পরিবার-পরিজনকে (যার নামে প্রবাসী টাকা পাঠান) ১০২ টাকা ৫০ পয়সা দেওয়া হয়।
২২ অক্টোবর থেকে ১০২ টাকা ৫০ পয়সার সঙ্গে আরও আড়াই টাকা অর্থাৎ মোট ১০৫ টাকা পাবেন।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এখন কোনো প্রবাসী ১ ডলার দেশে পাঠালে, যার নামে পাঠান তিনি ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬৯৪ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় মাস আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল; প্রতিদিন এসেছিল ৫৬৭ কোটি টাকা।
তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স প্রবাহে ধস নামে; আসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৪৮৯ কোটি টাকা।
তবে চতুর্থ মাস অক্টোবরে রেমিটেন্স প্রবাহে উল্লম্ফন দেখা যায়; আসে ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (প্রায় ২ বিলিয়ন) ডলার। প্রতিদিনের গড় হিসাবে আসে ৭০১ কোটি টাকা।
অক্টোবরের রেমিটেন্স ছিল চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। আগের মাস সেপ্টেম্বরের চেয়ে বেশি ছিল ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, নভেম্বরের ১৭ দিনে বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের মাধ্যমে ১০৭ কোটি ৪ লাখ ১০ হাজার ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৭ কোটি ৮৫ লাখ ২০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩ কোটি ৫১ লাখ ২০ হাজার ডলার।
এর বাইরে ৯টি বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স দেশে এনেছে।
তার পরও রিজার্ভ কমছে
রেমিটেন্সে বাড়লেও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে।
গত ৭ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর পাশপাশি রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, ওই দিনে বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। আর ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।
সবশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। তার আগে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) নিম্মমূখী।
এ পরিস্থিতিতে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ না পাওয়া পর্যন্ত রিজার্ভ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর আকুর দেনা পরিশোধ করা হয়। জুলাই-অগাস্ট মেয়াদের ওই বিল ছিল এক দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার।
আমদানির লাগাম টেনে ধরতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় এবার আকুর বিল আগের চেয়ে একটু কমেছে।
গত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ওই দিন ‘গ্রস’রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ হিসাবে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, দুই পদ্ধতিতে রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করার পর গত চার মাসে বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে কমেছে ৪ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি ব্যয়ে ধারগতির পরও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়লেও রপ্তানি আয়ে ধস এবং জ্বালানি তেল, সার, খাদ্যপণ্যসহ সরকারের অন্যান্য আমদানি খরচ মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণেই রিজার্ভ কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স। অক্টোবরে মাসে রপ্তানি আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এই মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়লেও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে রেমিটেন্স কমেছে ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
মহাসংকটে পড়ায় শ্রীলঙ্কা অবশ্য আকু থেকে বেরিয়ে এসেছে।
রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে কিন্তু চার মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আমদানি বেড়ে যদি ৬ বিলিয়ন হয়, তাহলে কিন্তু ৩ মাসের কিছু বেশি সময়ের খরচ মিটবে। তার মানে আমাদের রিজার্ভ কিন্তু উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে।”
“রিজার্ভ যেনো আর না কমে—সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমরা বার বার সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিলাম। গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেও অনুরোধ করেছিলাম।”
“কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। রিজার্ভ কমছেই। প্রকৃত রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলার নামা কিন্তু একটি স্পর্শকাতর মানদণ্ড।”
দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাব করতে বাংলাদেশ সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিল।
কিন্তু বাংলাদেশ সে বিষয়টি আমলে নেয়নি। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি সামাল দিতে গত জানুয়ারিতে আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ।
ঋণ সমঝোতার পর আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শ আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
বাাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের সেই শর্ত বা পরামর্শ মেনেই এখন রিজার্ভের দুই ধরনের তথ্যই প্রকাশ করছে।
কমেন্ট