রেমিটেন্সে ফের ধীরগতি, ২৪ দিনে এসেছে ১৪৯ কোটি ডলার
চলতি নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল; আশা করা হচ্ছিল এই মাসে ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে আসবে। রিজার্ভের উপর চাপ কমবে। কিন্তু মাসের শেষ দিকে এসে প্রবাসী আয়ে ফের ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। আর এই সূচকের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। কয়েক মাস কমার পর অক্টোবরে রেমিটেন্সে প্রবাহে সুবাতাস দেখা দিয়েছিল।
চলতি নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল; আশা করা হচ্ছিল এই মাসে ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে আসবে। রিজার্ভের উপর চাপ কমবে। কিন্তু মাসের শেষ দিকে এসে প্রবাসী আয়ে ফের ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ২৪ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ১৪৯ কোটি ২৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার (১.৪৯ বিলিয়ন) দেশে পাঠিয়েছেন।
প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৬ কোটি ২২ লাখ ডলার। মাসের বাকি ছয় দিনে (২৫ থেকে ৩০ নভেম্বর) এই হারে রেমিটেন্স আসলেও মাস শেষে মোট রেমিটেন্সের অঙ্ক দাঁড়াবে ১৮৬ কোটি ৬১ লাখ (১.৮৬ বিলিয়ন) ডলার।
নভেম্বর মাসের ২৪ দিনের রেমিটেন্সের তথ্যে দেখা যায়, ১ থেকে ৩ নভেম্বর দেশে রেমিটেন্স আসে ২০ কোটি ৫৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার। প্রতিদিনের গড় গিসাবে আসে ৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। ৪ থেকে ১০ নভেম্বর আসে প্রায় ৫৯ কোটি ডলার; প্রতিদিন আসে ৮ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।
১১ থেকে ১৭ নভেম্বর প্রবাসীরা পাঠান ৩৯ কোটি ৩৩ লাখ ডলার; প্রতিদিন পাঠান ৫ কোটি ৬২ লাখ ডলার। সবশেষ ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর—সপ্তাহে এসেছে ৩০ কোটি ৫২ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এই সাত দিনে প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার।
মাসের বাকি ছয় দিনে প্রবাসীরা প্রতিদিন ৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার করে রেমিটেন্স পাঠালে নভেম্বর মাসে মোট রেমিটেন্স আসবে ১৭৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার।
বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মাসের শুরুতে প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম ১২৩-১২৪ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ফলে বৈধ পথে (ব্যাংকিং চ্যানেল) প্রবাসী আয় পাঠানো বেড়ে যায়। পরে অবশ্য কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এতে রেমিটেন্স আবার কমছে।
গত ২২ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে আমদানি, রপ্তানি ও রেমিটেন্স—সব পর্যায়ে ডলারের দর ৫০ পয়সা করে কমানোর ঘোষণা দেয় বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)। ২৩ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়।
সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসী আয়ে ডলারের সর্বোচ্চ দাম এখন ১১০ টাকা। কিন্তু কোনো ব্যাংকই এই দরে রেমিটেন্স সংগ্রহ করছে না। রেমিটেন্স আহরণের শীর্ষ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সোমবার ১২০ টাকার বেশি দরে ডলার কিনেছে ব্যাংকগুলো।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে সরকারের বিদ্যমান প্রণোদনার বাইরে গত ২২ অক্টোবর থেকে আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
সরকার রেমিটেন্সে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে ২ টাকা ৫০ পয়সা বা আড়াই টাকা যোগ করে তার পরিবার-পরিজনকে (যার নামে প্রবাসী টাকা পাঠান) ১০২ টাকা ৫০ পয়সা দেওয়া হয়।
২২ অক্টোবর থেকে ১০২ টাকা ৫০ পয়সার সঙ্গে আরও আড়াই টাকা অর্থাৎ মোট ১০৫ টাকা পাবেন।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এখন কোনো প্রবাসী ১ ডলার দেশে পাঠালে, যার নামে পাঠান তিনি ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল।
তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স প্রবাহে ধস নামে; আসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।
তবে চতুর্থ মাস অক্টোবরে রেমিটেন্স প্রবাহে উল্লম্ফন দেখা যায়; আসে ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (প্রায় ২ বিলিয়ন) ডলার। অক্টোবরের রেমিটেন্স ছিল চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। আগের মাস সেপ্টেম্বরের চেয়ে বেশি ছিল ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, নভেম্বরের ২৪ দিনে বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের মাধ্যমে ১৩৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১০ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৪ কোটি ১৫ লাখ ২০ হাজার ডলার।
এর বাইরে ৯টি বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৪৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার রেমিটেন্স দেশে এনেছে।
রিজার্ভ কমছেই
রেমিটেন্সের ধীরগতির কারণে রিজার্ভ আরও কমছে। গত ৭ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নামে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার সবশেষ অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর পাশপাশি রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, ওই দিনে বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। আর ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
সবশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। তার আগে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) নিম্মমূখী।
এ পরিস্থিতিতে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ না পাওয়া পর্যন্ত রিজার্ভ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসা বেশ উদ্বেগজনক। প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে কিন্তু চার মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আমদানি বেড়ে যদি ৬ বিলিয়ন হয়, তাহলে কিন্তু ৩ মাসের কিছু বেশি সময়ের খরচ মিটবে। আর আমদানি খরচ যদি বেড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার হয়, তাহলে কিন্তু বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। তার মানে আমাদের রিজার্ভ কিন্তু উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে।”
“রিজার্ভ যেনো আর না কমে—সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমরা বার বার সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিলাম। গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেও অনুরোধ করেছিলাম।”
“কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। রিজার্ভ কমছেই। প্রকৃত রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলার নামা কিন্তু একটি স্পর্শকাতর মানদণ্ড।”
কমেন্ট