৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স ডিসেম্বরে

৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স ডিসেম্বরে

দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে।

সদ্য সমাপ্ত ডিসেম্বর মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

গত বছরের জুনে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

গত এক মাসে রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাড়ায় উদ্বেগ অনেকটা কেটে গেছে। আর তাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও কোরিয়া সরকারের ঋণের পাশাপাশি এই রেমিটেন্সের অবদান আছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারা।

আগের দুই মাস অক্টোবর ও নভেম্বরেও বেশ ভালো রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। অক্টোবরে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার; নভেম্বরে ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার রেমিটেন্স প্রবাহের মাসিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২৩ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে প্রবাসীরা ১৯৮ কোটি ৯৯ লাখ (প্রায় ২ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে এসেছিল ১৬৯ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৫ কোটি ৪৮ লাখ ডলার।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত ডিসেম্বরে আগের বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে।

ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনায় প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। এছাড়া অনেক ব্যাংক বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করায় প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তারা।

গত সেপ্টেম্বরে ১৩৩ দশমিক ৪৪ কোটি (১.৩৩ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। একক মাসের হিসাবে যা ছিল সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

২০২০ সালের প্রথম দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশে দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় লকডাউন; সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়।

কমতে শুরু করে রেমিটেন্স। সেই ধাক্কায় ২০২০ সালের মার্চে রেমিটেন্স ১২৭ কোটি ৬২ লাখ ডলারে নেমে আসে। এপ্রিলে তা আরও কমে ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলারে নেমে আসে।

এর পর থেকে অবশ্য রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়তে থাকে।

দুই বছর পর গত বছরের ২২ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে আমদানি, রপ্তানি ও রেমিটেন্স—সব পর্যায়ে ডলারের দর ৫০ পয়সা করে কমানোর ঘোষণা দেয় বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)। ২৩ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়।

২৯ নভেম্বর আরও ২৫ পয়সা কমানো হয়। দুই সপ্তাহ পর ১৩ ডিসেম্বর আরও ২৫ পয়সা কমানোর ঘোষণা দেয় বাফেদা ও এবিবি।

তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বিপরীতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর ১ টাকা কমানো হয়।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ের ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে কিনছে ব্যাংকগুলো। আর আমদানি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ১১০ টাকা দরে বিক্রি করছে।

তবে বাফেদা ও এবিবির বেঁধে দেওয়া দামে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দর ঘোষণা করে আসছে বাফেদা ও এবিবি।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে সরকারের বিদ্যমান প্রণোদনার বাইরে গত ২২ অক্টোবর থেকে আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

সরকার রেমিটেন্সে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে ২ টাকা ৫০ পয়সা বা আড়াই টাকা যোগ করে তার পরিবার-পরিজনকে (যার নামে প্রবাসী টাকা পাঠান) ১০২ টাকা ৫০ পয়সা দেওয়া হয়।

২২ অক্টোবর থেকে ১০২ টাকা ৫০ পয়সার সঙ্গে আরও আড়াই টাকা অর্থাৎ মোট ১০৫ টাকা পাচ্ছেন। এই আড়াই টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স প্রবাহে ধস নামে; আসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।

রিজার্ভ বাড়ছে

গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।

এক সপ্তাহ আগে ২১ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ৭৭ কোটি ডলার। আর ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়েছে ৭৮ কোটি ডলার।

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৯ কোটি ডলার, এডিবির ৪০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৯ কোটি ডলার যোগ হওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।

এছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ডলার কেনার ফলে রিজার্ভ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।

সবশেষ গত অক্টোবর মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে প্রায় চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

আইএমএফ, এডিবি ও দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণ যোগ হওয়ার আগে গত ১৩ ডিসেম্বর ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ১৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।

২২ দিনে রেমিটেন্স এসেছে ১৫৭ কোটি ডলার, মাস শেষে ২ বিলিয়ন ছাড়াবে পরবর্তী

২২ দিনে রেমিটেন্স এসেছে ১৫৭ কোটি ডলার, মাস শেষে ২ বিলিয়ন ছাড়াবে

কমেন্ট