রেমিটেন্স বাড়ছে, স্বস্তি ফিরছে অর্থনীতিতে
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে ২২ দিনে ১৫ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭০৩ কোটি টাকা।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।
চলতি মার্চ মাসের প্রথম ২২ দিনে ১৪১ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার (১.৪১ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আর এর উপর ভর করে দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা ডলারের ‘অস্থির’ বাজার ‘সুস্থির’ হতে শুরু করেছে।
কমতে শুরু করেছে ডলারের তেজ। মান বাড়ছে টাকার। কয়েক দিন আগে যেখানে ১২৪ টাকা পর্যন্ত দরে রেমিটেন্সের ডলার কিনছিল ব্যাংকগুলো; এখন তা ১১৪ টাকায় কিনছে। রবিবার আমদানি বিল নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম নেওয়া হয়েছে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ১২২ থেকে ১২৪ টাকা।
খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটেও ডলারের দরে বড় পতন হয়েছে। রবিবার প্রতি ডলার ১১৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাস খানেক আগেও তা ১২৬/১২৭ টাকায় বিক্রি হতো।
তবে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর এখনও অনেক কম; ১১০ টাকা। অর্থাৎ এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক ১১০ টাকায় ডলার কিনছে। বাংলাদেশ ব্যাংকগুলোর কাছে যে ডলার বিক্রি করছে, সোয়াপ কারেন্সির আওতায় টাকা-ডলার অদলবদল করছে সেটাও ১১০ টাকা নিচ্ছে।
মাস দু’য়েক আগে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর ১১০ টাকায় উঠেছিল।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘‘রেমিটেন্স বাড়তে শুরু করেছে। ডলার সংকট থাকবে না। অফশোর আইন করেছি, আশা করছি ঈদের পর আসবে। সাড়া-শব্দ পাচ্ছি, এটাতে টাকা পয়সা আসবে।”
রবিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত ‘আনপ্যাকিং দ্যা ইকোনমিক মেনিফেস্টো অব দ্যা আওয়ামী লীগ; ট্রেন্ডস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস ফর টুমোরোস বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে এ কথা বলেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, অফশোর ব্যাংকিং আইন করায় আগামী ঈদের পর সেখানে বিদেশি মুদ্রায় আমানত আসার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
“রপ্তানি আয় বাড়ছে। রেমিটেন্সও বাড়ছে। বাজারের ডলারের সরবরাহ বেড়েছে; ডলার সংকট থাকবে না। অফশোর আইন করেছি, আশা করছি ঈদের পর আসবে। সাড়া-শব্দ পাচ্ছি, এটাতে টাকা পয়সা আসবে।”
অফশোর ব্যাংকিং হল প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে সম্পূর্ণ বিদেশি মুদ্রায় পরিচালিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা। বিদেশি মুদ্রায় তহবিল সংগ্রহ করে বিনিয়োগ হয় এখানে।
এতদিন সরকারের একটি নীতিমালার মাধ্যমে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে অফশোর ব্যাংকিং পরিচালনার অনুমতি দিত বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এসে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের শেষ দিনে নীতিমালাটি আইনে পরিণত করে।
আইনি কাঠামো পাওয়ায় বিদেশি মুদ্রায় অফশোর ব্যাংকিংয়ে আমানত রাখবেন বিদেশিরা আশা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘অনেকে বলেছিল বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে। কই, বাংলাদেশ তো শ্রীলঙ্কা হয়নি। আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে অনেকেই এগিয়ে আসছে।”
বন্ধুপ্রতীম দেশের সঙ্গে জাপান, কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাত বিনিয়োগ করবে। চীনের নেতৃত্বে গঠিত এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) বাংলাদেশকে এখন ঋণ দিতে চায় বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
আমদানি ব্যয় কমায় এবং রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে বলেই দাম পড়ছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। এই ধারা চলতে থাকলে ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে মনে করছেন তিনি।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “আমদানি ব্যয় কমায় এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। সে কারণেই ডলারের দাম কমতে শুরু করেছে। এই ধারা ধরে রাখতে পারলে দুই বছর ধরে চলা ডলারের অস্থির বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে। যার ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়বে।”
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে এই ২২ দিনে ১৫ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭০৩ কোটি টাকা।
মাসের বাকি ৯ দিনে (২৩ থেকে ৩১ মার্চ) এই হারে এলেও মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারে গিয়ে ঠেকবে।
রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে চলতি মাসের বাকি দিনগুলোতে রেমিটেন্স প্রবাহ আরও বাড়বে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “অতীতে দেখা গেছে, রোজা ও দুই ঈদকে সামনে রেখে প্রবাসীরা তাদের পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে বেশি বেশি রেমিটেন্স পাঠান। সে বিষয়টি হিসাবে নিয়ে আশা করছি জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির মতো মার্চ মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে আসবে।”
আর এর মধ্যে দিয়ে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন মেজবাউল হক।
২০২৪ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১১ কোটি ৩১ লাখ (২.১১ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ফেব্রুয়ারি মাসে তার চেয়েও বেশি ২১৬ কোটি ৬০ লাখ (২.১৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন। যা ছিল আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
ফেব্রুয়ারি মাসে গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স এসেছিল । ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি ৪ লাখ (১.৫৬ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল।
গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে এসেছিল প্রায় ২ বিলিয়ন (১৯৯ কোটি ১২ লাখ) ডলার। তার আগের দুই মাস অক্টোবর ও নভেম্বরেও বেশ ভালো রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। অক্টোবরে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার; নভেম্বরে ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, মার্চ মাসের ২২ দিনে ১৪১ কোটি ৪৪ লাখ ডলার রেমিটেন্সের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৮ কোটি ২৫ লাখ ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২ কোটি ১৫ লাখ ডলার।
বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১২০ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। আর নয়টি বিদেশি ব্যাংক এনেছে ৫৭ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ১৫ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনায় প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। এছাড়া অনেক ব্যাংক বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করায় প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রেমিটেন্স বেড়েছে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৯১ শতাংশ।
আমদানির সাত মাসের (জুলাই-জানুয়ারি) তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সাত মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ।
রপ্তানি আয়ও ঊর্ধ্বমুখী। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—এই তিন মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের উত্থানও দেশের মুদ্রা বিনিময়ের বাজারে আস্থা ফেরাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। আর এতে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের যে পতনের ধারা ছিল, সেটাও ঠেকানো গেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু পদক্ষেপও মুদ্রাবাজারে আস্থা ফেরাতে অবদান রেখেছে। সম্প্রতি মুদ্রা অদলবদল বা সোয়াপ ব্যবস্থা চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে ডলারের সঙ্গে টাকার অদলবদল করতে পারছে। কারেন্সি সোয়াপের আওতায় ডলারের স্পট রেট অনুযায়ী ডলার নিয়ে ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কমেন্ট