এপ্রিলে রেমিটেন্স বেড়েছে ২১.২৫ শতাংশ
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর। ঈদের পরও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেড়েছে; যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
সদ্য সমাপ্ত এপ্রিল মাসে ২০৪ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার (২.০৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। আর আগের মাস মার্চের চেয়ে ২ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।
২০২৩ সালের এপ্রিলে ১৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার (১.৬৮ বিলিয়ন) পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত মার্চ মাসে পাঠান ১৯৯ কোটি ৭০ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। আর এই সূচকের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। গত কয়েক মাস ধরে রেমিটেন্স প্রবাহে বেশ ভালো গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর সে কারণে রিজার্ভ যতোটা কমবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা হয়নি।
সবাই ধারনা করেছিলেন, প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের পর রেমিটেন্স কম আসবে। কিন্তু তেমনটি না হয়ে উল্টো আরও বেশি এসেছে।
১১ এপ্রিল দেশে ঈদ উদযাপিত হয়। তার আগে পাঁচ দিনে (১ থেকে ৫ এপ্রিল) ব্যাংকিং চ্যানেলে ৪৫ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার ডলার পাঠান প্রবাসীরা। পরের সাত দিনে (৬ থেকে ১২ এপ্রিল) পাঠান ৪২ কোটি ১৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
ঈদের পরের সপ্তাহে (১৩ থেকে ১৯ এপ্রিল) এসেছিল ৪০ কোটি ৪৪ লাখ ১০ হাজার ডলার। তার পরের সপ্তাহে (২০ থেকে ২৬ এপ্রিল) আসে ৩৯ কোটি ৯৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
সবশেষ মাসের চার দিনে অর্থাৎ ২৭ থেকে ৩০ এপ্রিল এসেছে ৩৬ কোটি ২০ লাখ ৯০ হাজার ডলার।
সব মিলিয়ে এপ্রিল মাসে ২০৪ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে ১১০ টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে এপ্রিল মাসে ২২ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার বা ৭৫০ কোটি টাকা।
মার্চে ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
আগের দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছিল। জানুয়ারিতে এসেছিল ২.১১ বিলিয়ন ডলার; ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল আরও বেশি, ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবারই দুই ঈদের আগে রেমিটেন্সপ্রবাহ বাড়ে; ঈদের পর কমে যায়। কিন্তু এবার রোজার ঈদের আগে প্রবাসী আয় বাড়েনি। ঈদের পর না কমে উল্টো বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার রেমিটেন্সের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে ২ দশমিক শূন্য চার বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্সের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২১ কোটি ১২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৯ কোটি ৭২ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৭২ কোটি ৮০ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আর নয়টি বিদেশি ব্যাংক এনেছে ৬৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে প্রবাসীরা প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন।
আগের দুই মাস অক্টোবর ও নভেম্বরেও বেশ ভালো রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। অক্টোবরে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার; নভেম্বরে ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ১৯ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরের এই দশ মাসে ১৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনায় প্রবাসী আয় বেড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। এছাড়া অনেক ব্যাংক বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করায় প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১৩৩ দশমিক ৪৪ কোটি (১.৩৩ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। একক মাসের হিসাবে যা ছিল সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
২০২০ সালের প্রথম দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশে দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় লকডাউন; সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। কমতে শুরু করে রেমিটেন্স।
সেই ধাক্কায় ২০২০ সালের মার্চে রেমিটেন্স ১২৭ কোটি ৬২ লাখ ডলারে নেমে আসে। এপ্রিলে তা আরও কমে ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলারে নেমে আসে।
এর পর থেকে অবশ্য রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়তে থাকে।
রিজার্ভের পতন ঠেকাতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে সরকারের বিদ্যমান প্রণোদনার বাইরে গত বছরের ২২ অক্টোবর থেকে আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
সরকার রেমিটেন্সে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে ২ টাকা ৫০ পয়সা বা আড়াই টাকা যোগ করে তার পরিবার-পরিজনকে (যার নামে প্রবাসী টাকা পাঠান) ১০২ টাকা ৫০ পয়সা দেওয়া হয়।
২২ অক্টোবর থেকে ১০২ টাকা ৫০ পয়সার সঙ্গে আরও আড়াই টাকা অর্থাৎ মোট ১০৫ টাকা পাচ্ছেন। এই আড়াই টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
রিজার্ভ ১৯.৯৬ বিলিয়ন ডলার
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। আর আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার।
গত তিন সপ্তাহ ধরে এই দুই হিসাবেই রিজার্ভ প্রায় একই জায়গায় অবস্থান করছে। তবে আগামী সপ্তাহেই রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমে যাবে।
কেননা, আগামী সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। সেই বিল ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি হবে বলে জানা গেছে।
সে হিসাবে আকুর বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে। ‘গ্রস’ হিসাবে নামবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
আকু হলো—কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্ত–আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়।
কমেন্ট