সংকটে আলো দেখাচ্ছে রেমিটেন্স, ২৪ দিনেই এল ১.৮ বিলিয়ন ডলার
মাসের বাকি ৭ দিনে (২৫ থেকে ৩১ মে) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। যা হবে একক মাসের হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।
সংকটের মধ্যে আশার আলো দেখাচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এখন বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নিয়ে। আর এই সূচকের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্স বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্সের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি মে মাসের ২৪ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৭৮ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার (১.৭৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত বছরের মে মাসের পুরো সময়ের চেয়েও ৫ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
২০২৩ সালের মে মাসে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ (১.৬৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় রেমিটেন্স বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে মে মাসের ২৪ দিনে ২০ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলার বা ৮৭২ কোটি টাকা ২৫ লাখ টাকা।
মাসের বাকি ৭ দিনে (২৫ থেকে ৩১ মে) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। যা হবে একক মাসের হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।
এর আগে ২০২১ সালের জুলাইয়ে এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
ঈদের মাস এপ্রিলে ২০৪ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার (২.০৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার। গত কয়েক মাস ধরে রেমিটেন্স প্রবাহে বেশ ভালো গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
অনেকের ধারণা ছিল, প্রতিবারের মতো এবারও রোজার ঈদের পর রেমিটেন্স কম আসবে। কিন্তু তেমনটি না হয়ে উল্টো আরও বেশি আসছে।
গত ৯ মে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা-ডলারের বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করেছে। এই পদ্ধতিতে এখন থেকে দেশের মধ্যে ডলারের দর লাফ দিতে পারবে না, কেবল হামাগুড়ি দিতে পারবে। আর সেই হামাগুড়ি দিতে হবে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে। সীমার বাইরে যাওয়া যাবে না। আপাতত সেই সীমা হচ্ছে ১১৭ টাকা। এতে এক লাফে ডলারের দর বেড়েছে ৭ টাকা।
অর্থাৎ ব্যাংকগুলো এখন ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা দরে রেমিটেন্স সংগ্রহ করতে পারবে। এরসঙ্গে যোগ হবে সরকারের দেওয়া আড়াই শতাংশ প্রণোদনা।
‘ক্রলিং পেগ’ চালুর ফলে ডলারের দাম বাড়ায় রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া কোরবানির ঈদ সামনে রেখে রেমিটেন্স আরও বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তারা।
গত ১১ এপ্রিল দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে।
গত মার্চে ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
আগের দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছিল। জানুয়ারিতে এসেছিল ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল আরও বেশি, ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে প্রবাসীরা প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স পাঠান।
আগের দুই মাস অক্টোবর ও নভেম্বরেও বেশ ভালো রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। অক্টোবরে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার। নভেম্বরে আসে ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল ) ১৯ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরের এই দশ মাসে ১৭ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল তার আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
প্রতিবারই দুই ঈদের আগে রেমিটেন্সপ্রবাহ বাড়ে; ঈদের পর কম আসে। কিন্তু এবার রোজার ঈদের আগে প্রবাসী আয় বাড়েনি। ঈদের পর অবশ্য বেশি আসছে।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সংকটের সময়ে ডলারের দাম বাড়িয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন রেমিটেন্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়বে। আর এতে রিজার্ভের পতন ঠেকবে।”
রিজার্ভ বেড়েছে
এদিকে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ খানিকটা বেড়েছে। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উদ্বেগের এক নাম এখন রিজার্ভ। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছিল ২৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সপ্তাহে একদিন রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে। সেই তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ মে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।
১৪ মে আকুর দেনা শোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ‘গ্রস’ হিসাবে নেমেছিল ২৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, নয় দিনে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ৩৬ কোটি ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়েছে ৩৭ কোটি ডলার।
কমেন্ট