রেমিটেন্সের পালে হাওয়া, মে মাসে বেড়েছে ৩৩%

রেমিটেন্সের পালে হাওয়া, মে মাসে বেড়েছে ৩৩%

কোরবানির ঈদ এবং টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় রেমিটেন্স বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

সংকটের মধ্যে আশার আলো দেখাচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এখন বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নিয়ে। আর এই সূচকের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্স পালে হাওয়া লেগেছে।

সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে ২২৫ কোটি (২.২৫ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত বছরের মে মাসের চেয়ে ৩২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি।আগের মাস এপ্রিলের চেয়ে বেশি ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ।

একক মাসের হিসাবে মে মাসের এই রেমিটেন্স দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৬০ কোটি (২.৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

২০২৩ সালের মে মাসে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ (১.৬৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।

কোরবানির ঈদ এবং টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় রেমিটেন্স বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে মে মাসে ২৬ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার বা ৮৫০ কোটি টাকা টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পরিবার-পরিজনের বাড়তি খরচের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। ডলারের দাম বাড়াতেও রেমিটেন্সে বাড়ছে।”

গত এপ্রিলে ২০৪ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার (২.০৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার। গত কয়েক মাস ধরে রেমিটেন্স প্রবাহে বেশ ভালো গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আশঙ্কা ছিল, প্রতিবারের মতো এবারও রোজার ঈদের পর রেমিটেন্স কম আসবে। কিন্তু তেমনটি না হয়ে উল্টো আরও বেশি এসেছে।

গত ৯ মে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা-ডলারের বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করেছে। এই পদ্ধতিতে এখন থেকে দেশের মধ্যে ডলারের দর লাফ দিতে পারবে না, কেবল হামাগুড়ি দিতে পারবে। আর সেই হামাগুড়ি দিতে হবে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে। সীমার বাইরে যাওয়া যাবে না। আপাতত সেই সীমা হচ্ছে ১১৭ টাকা। এতে এক লাফে ডলারের দর বেড়েছে ৭ টাকা।

অর্থাৎ ব্যাংকগুলো এখন ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা দরে রেমিটেন্স সংগ্রহ করছে। এরসঙ্গে যোগ হচ্ছে সরকারের দেওয়া আড়াই শতাংশ প্রণোদনা।

গত ১১ এপ্রিল দেশে ঈদুল ফিতর (রোজার ঈদ) উদযাপিত হয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে।

মার্চ মাসে ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।

আগের দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছিল। জানুয়ারিতে এসেছিল ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল আরও বেশি, ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।

গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে প্রবাসীরা প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার পাঠিয়েছিলেন।

আগের দুই মাস অক্টোবর ও নভেম্বরেও বেশ ভালো রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। অক্টোবরে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার। নভেম্বরে আসে ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ২১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।

গত অর্থবছরের এই ১১ মাসে ১৯ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে (জুলাই-জুন) ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল তার আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।

প্রতিবারই দুই ঈদের আগে রেমিটেন্সপ্রবাহ বাড়ে; ঈদের পর কম আসে। কিন্তু এবার রোজার ঈদের পর রেমিটেন্স কমেনি; উল্টো বেড়েছে।

অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সংকটের সময়ে রেমিটেন্স বাড়ায় কিছুটা হলেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ডলারের দাম বাড়িয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন রেমিটেন্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়বে। আর এতে রিজার্ভের পতন ঠেকবে বলে মনে হচ্ছে।”

“হতাশ হওয়ার কিছু নেই। গত ৯ মে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা-ডলার বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করেছে। এর পর থেকে ডলারের বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। রিজার্ভও বাড়বে।”

তিনি বলেন, “রিজার্ভ কমায় সার্বিক বিষয় বিবেচনা নিয়ে আইএমএফ বাংলাদেশের নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়েছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত আইএমএফের দেওয়া নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। এ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আইএমএফ ১৪ দশমিক ৭৫ কোটি ডলারে নামিয়েছে। এটা একটা স্বস্তির খবর।”

“জুন মাসের শেষের দিকে আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে। তখন রিজার্ভ আরও বাড়বে।

“আমার মনে হয়, রিজার্ভ আর কমবে না; বাড়তেই থাকবে,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।

বাংলাদেশ ব্যাংক সপ্তাহে একদিন রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে। সেই তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ মে আইএমএফ হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।

১৪ মে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। ‘গ্রস’ হিসাবে নেমেছিল ২৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে।

সংকটে আলো দেখাচ্ছে রেমিটেন্স, ২৪ দিনেই এল ১.৮ বিলিয়ন ডলার পরবর্তী

সংকটে আলো দেখাচ্ছে রেমিটেন্স, ২৪ দিনেই এল ১.৮ বিলিয়ন ডলার

কমেন্ট