২৩ দিনেই ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স, মাস শেষে রেকর্ডের আশা
মাসের বাকি ৭ দিনে এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। যা হবে একক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।
ঈদের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে কিছুটা ভাটা পড়েছে; তার পরও একক মাসের হিসাবে জুনে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎসে রেকর্ড হতে চলেছে।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ২৩ দিনেই ২০৫ কোটি (২.০৫ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১১৮ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ২৪ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮ কোটি ৯১ লাখ ডলার; টাকার হিসাবে ১ হাজার ৫২ কোটি
আর এই রেমিটেন্সের উপর ভর করে রিজার্ভ আরও বেড়েছে; বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ সাড়ে ১৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার রেমিটেন্সের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ২৩ দিনে (১ থেকে ২৩ জুন) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ২০৫ কোটি ডলারের যে রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন, তার মধ্যে ঈদের আগে ১ থেকে ৭ জুন সপ্তাহে এসেছিল ৭২ কোটি ৬২ লাখ ৯০ হাজার ডলার। ৮ থেকে ১৪ জুন দ্বিতীয় সপ্তাহে আসে ৯২ কোটি ৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার। ঈদের পর ১৫ থেকে ২১ জুন সপ্তাহে আসে ২৬ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
পরের দুই দনি অর্থাৎ ২২ ও ২৩ জুন এসেছে ১৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার ডলার।
১৭ জুন দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে।
মাসের বাকি ৭ দিনে (২৪ থেকে ৩০ জুন) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২৬৭ কোটি (২.৬৭ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়ে যাবে। যা হবে একক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।
২০২০ সালের জুলাই মাসে এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
গত বছরের জুনে ২১৯ কোটি ৯০ লাখ (২.২০ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
বরাবরই দুই ঈদের পর রেমিটেন্সের গতি কমে যায়। সে হিসাবে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা জানতে আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
এমনিতেই গত কয়েক মাস ধরে রেমিটেন্সের গতি ভালো ছিল; ঈদের আগে তা আরও বেড়েছে।
গত মে মাসে ২২৫ কোটি (২.২৫ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত বছরের মে মাসের চেয়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ বেশি। আগের মাস এপ্রিলের চেয়ে বেশি ছিল ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। প্রতিদিনের গড় হিসাবে মে মাসের রেমিটেন্স ছিল ৭ কোটি ২৭ লাখ ডলার।
একক মাসের হিসাবে মে মাসের রেমিটেন্স ছিল দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
তার আগের মাস এপ্রিলে ২০৪ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার (২.০৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার।
মার্চ মাসে ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
তার আগের দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছিল। জানুয়ারিতে এসেছিল ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল আরও বেশি, ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে প্রবাসীরা প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার পাঠিয়েছিলেন।
আগের দুই মাস অক্টোবর ও নভেম্বরেও ভালো রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। অক্টোবরে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার। নভেম্বরে আসে ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২৩-২৪ প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ২১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরের এই ১১ মাসে ১৯ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে (জুলাই-জুন) ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল তার আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এমনিতেই বেশ কয়েক মাস ধরে রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। টাকা-ডলারের বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর ফলে ডলারের দাম বেশ খানিকটা বেড়েছে। তার প্রভাব রেমিটেন্সে পড়েছে।”
“এছাড়া কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পরিবার-পরিজনের বাড়তি খরচের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।”
গত ৯ মে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা-ডলারের বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করেছে। সেই পদ্ধতিতে টাকা-ডলারের বিমিয় হার হবে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা।
অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ১১৭ থেকে ১১৮ টাকার মধ্যে রেমিটেন্স সংগ্রহ করতে পারবে। এরসঙ্গে যোগ হবে সরকারের দেওয়া আড়াই শতাংশ প্রণোদনা।
সোমবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১৮ টাকা।
রিজার্ভ বাড়ছে
প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর পাশাপাশি রিজার্ভের তথ্যও প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে ১৪ জুন বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
দুই সপ্তাহ আগে গত ৫ জুন বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ৩২ কোটি ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়েছে ২৬ কোটি ডলার।
দুই সপ্তাহে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ৮৬ কোটি ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়েছে ৫৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ গত মার্চ মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ বর্তমানের ১৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে প্রায় চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
২৪ জুন (সোমবার) যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফের সদর দপ্তরে সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন দেওয়ার কথা রয়েছে; অনুমোদন হলে কয়েক দিনের মধ্যেই ওই ঋণ রিজার্ভে যোগ হবে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) বাজেট সহায়তার ২৫ কোটি ডলারও এ মাসেই রিজার্ভে যোগ হবে। গত ১০ জুন এডিবি’র সঙ্গে এই ঋণের চুক্তি সই করেছে ইআরডি।
এছাড়া এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) ৪০ কোটি ডলার এবং কোরিয়া সরকার ১০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা দিচ্ছে। নিচ্ছে। জুন মাসের মধ্যে এই ৫০ কোটি ডলারও রিজার্ভে যোগ হবে বলে জানিয়েছেন ইআরডি’র কর্মকর্তারা।
সব মিলিয়ে জুনের মধ্যেই বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
কমেন্ট