রেমিটেন্স কতটা কমল, কেন কমল
দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স প্রবাহে ধীরগতি নিয়ে শুরু হয় নতুন অর্থবছর। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে তা আরও কমেছে।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক এখন বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। এই সূচকের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স।
গেলো অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ৪৭ লাখ ডলার।
একক মাসের হিসাবে জুনের রেমিটেন্স ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৬০ কোটি (২.৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিল প্রবাসীরা। গত বছরের জুনের চেয়ে এই বছরের জুনে ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি এসেছিল এসেছিল দেশে।
কিন্তু নতুন অর্থবছরের শুরুতে রেমিটেন্স প্রবাহের সেই উল্লম্ফন আর নেই। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের ২৪ দিনে (১ থেকে ২৪ জুলাই) ১৫০ কোটি (১.৫০ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৬ কোটি ২৫ লাখ ডলার।
মাসের বাকি ৭ দিনে (২৫ থেকে ৩১ জুলাই) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ১৯৩ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার হবে।
দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স প্রবাহে ধীরগতি নিয়ে শুরু হয় নতুন অর্থবছর। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে তা আরও কমেছে।
দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে চলতি জুলাই মাসে রেমিটেন্স আরও পতনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও এর আগের মাসেই এই সূচকে উল্লম্ফন দেখা গিয়েছিল।
সাম্প্রতিক তথ্যে রেমিটেন্সের যে অধঃগতি দেখা যাচ্ছে, তা ইন্টারনেট বন্ধ থাকার প্রভাব বলে দাবি করছেন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান। তিনি বলছেন, পরিস্থিতি ঠিক হলে আগের মতোই রেমিটেন্স আসবে।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সহিংস পরিস্থিতির কারণে পাঁচ দিন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। সে কারণে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্সও কম এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের প্রথম ছয় দিনে (১ থেকে ৬ জুলাই) ৩৭ কোটি ৫ লাখ ডলার রেমিটেন্সে এসেছে দেশে। ৭ থেকে ১৩ জুলাই এসেছে ৬০ কোটি ৮১ লাখ ডলার। ১ থেকে ১৮ জুলাই এসেছে ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার।
সব মিলিয়ে ১ থেকে ২৪ জুলাই এসেছে ১৫০ কোটি ডলার। গত বছরের ১ থেকে ২৪ জুলাই দেশে বৈধ পথে অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৫৮ কোটি ৬০ লাখ (১.৫৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে কোনও ব্যাংক পাঁচ দিন রেমিটেন্স সংগ্রহ করতে পারেনি। এখন ইন্টারনেট চালু হওয়ায় এখন প্রবাহ স্বাভাবিক হয়েছে। প্রবাসীরা আগের মতোই রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন।”
জুলাই মাসে রেমিটেন্স কম কেন—এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “প্রতি মাসেই রেমিটেন্স উঠানামা করে। কোনও মাসে বেশি আসে, কোনও মাসে একটু কম আসে। আবার কোনও সপ্তাহে কম আসে, কোনও সপ্তাহে বেশি আসে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় পাঁচ দিন রেমিটেন্স আসেনি। এখন স্বাভাবিক হয়েছে। মাস শেষে বোঝা যাবে কত রেমিটেন্স এসেছে।”
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। তবে এই ধরনের প্রচারে বিভ্রান্ত না হতে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।
গত ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলেছে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ওই দিন লেনদেন চলে বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রবাসী আয় আসাও সম্ভব ছিল না। এ সময়ের মধ্যে যারা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন, ২৪ জুলাই ব্যাংক খোলার প্রথম দিন তার পুরোটা দেশের ব্যাংকগুলোতে জমা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, যদি কেউ বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠিয়ে থাকেন, ব্যাংকগুলো তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিতরণ করতে বাধ্য। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের প্রবাসী আয় প্রেরণকারী রেমিট্যান্স হাউসগুলো যদি এ আয় ধরে রাখে, তাতে তা দেশে আসতে কিছুটা সময় লাগে।
সে কারণে ১৯ থেকে ২৩ জুলাই প্রবাসীরা যে রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন তা ২৪ ও ২৫ জুলাই দেশে এসেছে। ২৬ ও ২৭ জুলাই শুক্র ও শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। ওই পাঁচ দিনের রেমিটেন্সের প্রকৃত তথ্য ২৮ জুলাই (রবিবার) পাওয়া যাওয়ার কথা।
কিন্তু ২৪ জুলাইয়ের পর রেমিটেন্সের কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১ থেকে ১৮ জুলাই প্রবাসী আয় এসেছিল ১২৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আর চলতি বছরের ১ থেকে ১৮ জুলাই দেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় এসেছে ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার।
ফলে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনে প্রবাসী আয় ছিল প্রবৃদ্ধির ধারায়। চলতি মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল।
গত বছরের ১ থেকে ২৪ জুলাই দেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৫৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। চলতি মাসের একই সময়ে এসেছে ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম ১৮ দিনে এসেছিল ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার। আর ১৯ থেকে ২৪ জুলাই ছয় দিনে এসেছে ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার এসেছিল দেশে; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
অর্থবছরের হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছে দেশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স।
পাঁচ বছর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এক লাফে ৩৬ দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়ে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
পরের অর্থবছরে (২০২১-২২) অবশ্য তা কমে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আসে একটু বেশি, ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।
কমেন্ট