দৈনিক হাজার কোটি টাকার রেমিটেন্স আসছে দেশে
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা কেটে গেছে; বাড়ছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্স প্রবাহের ঊর্ধমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্সের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরের প্রথম সাত দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ৫৮ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৭ হাজার ১৫ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮ কোটি ৩৫ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে এক হাজার ৫ কোটি টাকা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা কেটে গেছে; বাড়ছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।
অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ২২২ কোটি ১৩ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত বছরের আগস্টের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি।
প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৭ কোটি ১৬ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ছিল ৮৬০ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর আরও দুই টাকা বাড়ায় রেমিটেন্স প্রবাহে গতি এসেছে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি অর্থ পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ার একটি কারণ বলে জানিয়েছেন তারা।
গত ২০ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দাম আরও ২ টাকা বেড়েছে। এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে প্রতি ডলার ১২০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও রেমিটেন্স সংগ্রহসহ সব ক্ষেত্রেই ১২০ টাকা দরে ডলার লেনদেন করছে।
গত ২০ আগস্টের আগে আন্তঃব্যাংক লেনদেনসহ সব ক্ষেত্রেই ১১৮ টাকায় ডলার লেনদেন হয়।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিটেন্স কমেছিল। ওই মাসে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ছিল ৭২৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য শেখ হাসিনার সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
গত ১৯-২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা দমাতে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করেছিল বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯-২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনও প্রবাসী আয় আসেনি।
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ৪৭ লাখ ডলার; টাকার হিসাবে দৈনিক রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার কোটি টাকা।
একক মাসের হিসাবে জুন মাসের রেমিটেন্স ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৬০ কোটি (২.৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিল প্রবাসীরা। গত বছরের জুনের চেয়ে এই বছরের জুনে ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
সব মিলিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারীর সময়ে একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একইসঙ্গে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।
সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স দেশে আসার ক্ষেত্রে। তবে জুলাই মাসে সেই ধারায় কিছুটা ছন্দপতন হয়।
রিজার্ভ ২০.৫৫ বিলিয়ন ডলার
দেশে রেমিটেন্স প্রবাহে গতি এলেও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না।
গত বৃহস্পতিবার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
চলতি সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মাসের ১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের মতো আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে ১৯ বিলিয়ন ডলারের সামন্য কিছু উপরে অবস্থান করবে বলে হিসাব বলছে। আর ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে।
এক সপ্তাহ আগে ২৮ আগস্ট বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
এক বছর আগে গত বছরের ৪ সেপ্টম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৯ দমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।
ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সোম অথবা মঙ্গলবার আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করা হবে।”
এবার আকুর বিল ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি হতে পারে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ গত জুন মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে আকুর দেনা পরিশোধের পর ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ যে রিজার্ভ থাকবে, তা দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
সেই ক্ষেত্রে রিজার্ভ টানটান অবস্থায় থাকবে।
আকু হলো- কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়।
অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছর এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে শ্রীলঙ্কা।
কমেন্ট