১৪ দিনে এল ১৪ হাজার কোটি টাকার রেমিটেন্স
মাসের বাকি ১৬ দিনে এই হারে এলে মাস শেষে এই অঙ্ক ২৫০ কোটি (২.৫০ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়ে যাবে। একক মাসের হিসাবে যা হবে তৃতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্সের ঊর্ধমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৪ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১১৬ কোটি ৭২ লাখ (১.১৭ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৪ হাজার ৬ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে এক হাজার কোটি টাকা।
মাসের বাকি ১৬ দিনে (১৫ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর) এই হারে এলে মাস শেষে এই অঙ্ক ২৫০ কোটি (২.৫০ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়ে যাবে। একক মাসের হিসাবে যা হবে তৃতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ ১ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর ৫৮ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ ৮ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর এসেছে প্রায় একই—৫৮ কোটি ২৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে যে ধাক্কা লেগেছিল তা কেটে গেছে; বাড়ছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।
অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ২২২ কোটি ১৩ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত বছরের আগস্টের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি।
প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৭ কোটি ১৬ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ছিল ৮৬০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর আরও দুই টাকা বাড়ায় রেমিটেন্স প্রবাহে গতি বেড়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি অর্থ পাঠানোয় রেমিটেন্স বাড়ার একটি কারণ বলে জানিয়েছেন তারা।
গত ২০ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দাম আরও ২ টাকা বেড়েছে। এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে প্রতি ডলার ১২০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও রেমিটেন্স সংগ্রহসহ সব ক্ষেত্রেই ১২০ টাকা দরে ডলার লেনদেন করছে।
২০ আগস্টের আগে আন্ত:ব্যাংক লেনদেনসহ সব ক্ষেত্রেই ১১৮ টাকায় ডলার লেনদেন হয়।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিটেন্স কমেছিল। ওই মাসে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ছিল ৭২৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ৪৭ লাখ ডলার; টাকার হিসাবে দৈনিক রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার কোটি টাকা।
একক মাসের হিসাবে জুন মাসের রেমিটেন্স ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৬০ কোটি (২.৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিল প্রবাসীরা। গত বছরের জুনের চেয়ে এই বছরের জুনে ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
সব মিলিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারির সময়ে একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সাথে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।
সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স দেশে আসার ক্ষেত্রে। তবে জুলাই মাসে সেই ধারায় কিছুটা ছন্দপতন হয়।
রিজার্ভ ১৯.৪৪ বিলিয়ন ডলার
তবে রেমিটেন্স বাড়লেও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে।
গত বৃহস্পতিবার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।
গত ৯ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মাসের ১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমেছে।
আকুর দেনা শোধের আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৬২বিলিয়ন ডলার।
এক বছর আগে গত বছরের ১১ সেপ্টম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৭ দমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
কমেন্ট