৪ মাসেই ৯ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স, অক্টোবরে বেড়েছে ২১.৫০%
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে অক্টোবরের রেমিটেন্স ২৮ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ৯২৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের পর অক্টোবরেও ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ মাস সেপ্টেম্বরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
এই অঙ্ক গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। একক মাসের হিসাবে অক্টোবরের রেমিটেন্স চতুর্থ সর্বোচ্চ।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) প্রায় ৯ বিলিয়ন (৯০০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
গত বছরের অক্টোবরে ১৯৭ কোটি ১৪ লাখ (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। একক মাসের হিসাবে যা ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে অক্টোবরের রেমিটেন্স ২৮ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ৯২৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
এর আগে এক মাসের হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল ২০২০ সালের জুলাই মাসে—২৫৯ কোটি ৭৭ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল গত জুন মাসে—২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে যে ধাক্কা লেগেছিল তা কেটে গেছে; বাড়ছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।
অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ২২২ কোটি ১৩ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত বছরের আগস্টের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বাড়ায় রেমিটেন্স প্রবাহে গতি বেড়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা।
গত ২০ আগস্ট থেকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে প্রতি ডলার ১২০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও রেমিটেন্স সংগ্রহসহ সব ক্ষেত্রেই ১২০ টাকা দরে ডলার লেনদেন করছে। ২০ আগস্টের আগে আন্ত:ব্যাংক লেনদেনসহ সব ক্ষেত্রেই ১১৮ টাকায় ডলার লেনদেন হয়।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিটেন্স কমেছিল। ওই মাসে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ৮৯৩ কোটি ৭১ লাখ (৮.৯৪ বিলিয়ন) ডলার। যা গত অর্থবছরের এই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৬৮৭ কোটি ৮৪ লাখ (৬.৮৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
সব মিলিয়ে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারির সময়ে একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সাথে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।
সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স দেশে আসার ক্ষেত্রে। তবে জুলাই মাসে সেই ধারায় কিছুটা ছন্দপতন হয়।
গত তিন মাস ধরে (আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) ফের বাড়ছে।
রিজার্ভ ১৯.৮৭ বিলিয়ন ডলার
রেমিটেন্স বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ খানিকটা বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই সূচক বেড়েছে ৭ কোটি ডলার।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সপ্তাহের ব্যবধানে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ৭ কোটি ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়েছে ১৪ কোটি ডলার।
চলতি সপ্তাহেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে; তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
গত ৯ সেপ্টেম্বর আকুর জুলাই-আগস্ট মাসের ১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। আকুর দেনা শোধের আগে ৫ সেপ্টেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে রিজার্ভের পাশপাশি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকের হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়।
‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক মাস আগে ৩০ সেপ্টেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার।
এক বছর আগে গত বছরের ৩০ অক্টোবর বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার।
কমেন্ট