সাড়ে ৪ মাসেই ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল রেমিটেন্স
মাসের বাকি ১৭ দিনে এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক আড়াই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২৫১ কোটি ৫৩ লাখ (২.৫১ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। একক মাসের হিসাবে যা হবে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের পর চলতি নভেম্বর মাসেও বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার রেমিটেন্স প্রবাহের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরের প্রথম ১৩ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১০৯ কোটি (১.০৯ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ৬ কোটি টাকা।
মাসের বাকি ১৭ দিনে (১৪ থেকে ৩০ নভেম্বর) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক আড়াই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২৫১ কোটি ৫৩ লাখ (২.৫১ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। একক মাসের হিসাবে যা হবে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২৬০ কোটি (২.৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছিল গত জুনে ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার।
গত বছরের নভেম্বরে ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
চলতি অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা ছিল গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেছিল ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন)
অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ৮৯৩ কোটি ৭১ লাখ (৮.৯৪ বিলিয়ন) ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চার মাস ১৩ দিনে (১ জুলাই থেকে ১৩ নভেম্বর) ১ হাজার ৩ কোটি (১০.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি।
গত বছরের ১ জুলাই থেকে ১৩ নভেম্বর ৭৮৮ কোটি (৭.৮৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারির সময়ে একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সাথে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।
সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স দেশে আসার ক্ষেত্রে।
তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সেই ধারায় কিছুটা ছন্দপতন হয়। ওই মাসে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১. ৯১ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্সে আসে দেশে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
রিজার্ভ ১৮.৪৪ বিলিয়ন ডলার
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উদ্বেগের এক নাম এখন রিজার্ভ। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধের পর সেই উদ্বেগ আরও বেড়েছে। রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ার পরও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে পতন থামছে না।
গত ১২ নভেম্বর আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নামে ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
এই রিজার্ভ ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। গত ১২ মে আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছিল ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এবার আকুর বিল একটু বেশি হয়েছে; ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। সেই বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে যায়।”
‘তবে উদ্বেগের কিছু নেই’ জানিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ছে। কিছুদিনের মধ্যেই রিজার্ভ আবার বাড়বে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে ১৮ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
আকু হলো—কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্ত–আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়।
অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছর এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে শ্রীলঙ্কা।
অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলেছে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
কমেন্ট