রেমিটেন্সে উল্লম্ফন, ২১ দিনেই এল ২ বিলিয়ন ডলার

রেমিটেন্সে উল্লম্ফন, ২১ দিনেই এল ২ বিলিয়ন ডলার

মাসের বাকি ১০ দিনে এই হারে এলে প্রথমবারের মতো এক মাসে প্রায় ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারের রেমিটেন্স আসবে দেশে।

দেশের অর্থনীতির উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উলম্ফন অব্যাহত রয়েছে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরের পর চলতি বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরেও বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ষষ্ট মাস ডিসেম্বরের প্রথম ২১ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২০০ কোটি ৭২ লাখ ৩০ হাজার (২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।

বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ২৪ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৯ কোটি ৫৬ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা এক হাজার ১৪৭ কোটি টাকা।

মাসের বাকি ১০ দিনে (২২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর) এই হারে এলে প্রথমবারের মতো এক মাসে প্রায় ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারের রেমিটেন্স আসবে দেশে।

একক মাসের হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল ২০২০ সালের জুলাই মাসে—২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল গত জুন মাসে—২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার।

গত বছরের ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ১২ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

চলতি অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা ছিল গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি।

চতুর্থ মাস অক্টোবরে এসেছিল ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।

তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন)।

অর্থবছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) হিসাবে এক হাজার ১১৩ কোটি ৭৩ লাখ (১১.১৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৮৮০ কোটি ৮৪ লাখ (৮.৮১ বিলিয়ন) প্রবাসী আয় এসেছিল দেশে।

সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পাঁচ মাস ২১ দিনে (১ জুলাই থেকে ২১ ডিসেম্বর) ১ হাজার ৩১৬ কোটি ৭৩ লাখ (১৩.১৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।

ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।

দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারীর সময়ে আমদানি তলানিতে নামায় একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সাথে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।

সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ে।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।

রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার

দেশে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেড়ে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে যা বেড়েছে দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি। আর এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে পৌনে এক বিলিয়ন ডলার।

রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক বাড়ছে। এছাড়া আইএমএফের শর্ত মেনে চলতি ডিসেম্বর শেষে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কেনার কারণেও রিজার্ভ বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ বেড়ে ১৯ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। গ্রস হিসাবে হয়েছে ২৪ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।

একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবের জন্য প্রচলিত রয়েছে দুটি পদ্ধতি। একটি হলো নিট, অন্যটি গ্রস।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সদস্য দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করার জন্য একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। যেটিকে বলা হয় ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন, সংক্ষেপে বিপিএম-৬।

বৈদেশিক সম্পদ গণনার ক্ষেত্রে সব বৈদেশিক দায়, ঋণ ও রিজার্ভের অর্থ অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করলে বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে তা মূল রিজার্ভ থেকে বাদ যায়।

সে হিসেবে, গত ১১ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গ্রস হিসাবে নেমেছিল ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে রিজার্ভের পাশপাশি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকের হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলেছে জুলাই-নভেম্বর সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ১৯ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।

হাজার কোটি টাকার বেশি রেমিটেন্স আসছে প্রতিদিন পরবর্তী

হাজার কোটি টাকার বেশি রেমিটেন্স আসছে প্রতিদিন

কমেন্ট