রেমিটেন্সের উল্লম্ফনে হোঁচট

রেমিটেন্সের উল্লম্ফনে হোঁচট

গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের প্রথম ২১ দিনেই ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে যা ছিল ৯ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।

অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো যখন বার্তা দিচ্ছিল দুঃসংবাদের, তখন রেমিটেন্সই দেখাচ্ছিল আশা; এখন সেই প্রবাসী আয়েও দেখা যাচ্ছে ধীর গতি।

বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্সের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, নতুন বছরের প্রথম মাস এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সপ্তম মাস জানুয়ারির ১৮ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১২০ কোটি ৬৯ লাখ (১.২০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।

বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৪ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ৮১৯ কোটি টাকা।

অথত গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের প্রথম ২১ দিনেই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি ৭২ লাখ) ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৯ কোটি ৫৬ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ছিল এক হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। মাস শেষে মোট রেমিটেন্স আসে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার।

যা ছিল একক মাসের হিসাবে সবচেয়ে বেশি। এর আগে এক মাসে এত রেমিটেন্স কখনই আসেনি। টাকার হিসাবে ডিসেম্বরে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ৫১ লাখ ডলার; টাকায় ছিল এক হাজার ৩৯ কোটি টাকা।

এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল গত জুন মাসে, ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ১২ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এ হিসাবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে ৩২ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২.২০ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। যা ছিল আগের বছরের নভেম্বরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।

চতুর্থ মাস অক্টোবরে এসেছিল ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। প্রতিদেনর গড় হিসাবে এসেছিল ৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার।

তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ডলারের বেশি।

দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার; প্রতিদিনের গড় হিসাবে যা ছিল ৭ কোটি ১৭ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন)। প্রতিদিনের গড় হিসাবে ছিল ৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসের পাঁচ মাসই ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে দেশে। এর আগে কখনই এমনটা দেখা যায়নি।

অর্থবছরের ছয় মাসের (প্রথমার্থ, জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে এক হাজার ৩৭৭ কোটি ৭১ লাখ (১৩.৭৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১ হাজার ৮০ কোটি (১০.৮০ বিলিয়ন) ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল দেশে।

গত অর্থবছরে মোট ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।

বছরের হিসাবে দেখা যায়, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২৪ সালে ২ হাজার ৬৮৮ কোটি ৮৬ লাখ (২৬.৮৯ বিলিয়ন) রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি।

বছরের হিসাবে এর আগে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছিল ২০২২ সালে, ২২ দশমিক শূন্য সাত (২২.০৭ বিলিয়ন) ডলার।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমে গিয়েছিল।

ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।

ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।

তবে টানা কয়েক মাসের উল্লম্ফনের পর নতুন বছরের প্রথম মাসে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্সে নিম্মমূখী ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ডিসেম্বরের ১৮ দিনে যে রেমিটেন্স এসেছে, মাসের বাকি ১৩ দিনে (১৯ থেকে ৩১ জানুয়ারি) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক দাঁড়াবে ২০৭ কোটি ৮৫ লাখ (২.০৭ বিলিয়ন) ডলার। যা হবে ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।

রিজার্ভ ২০.১৩ বিলিয়নে ডলার

এদিকে বর্তমান সময়ে অর্থনীতির উদ্বেগজনক সূচক রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটছে না। গত ৯ জানুয়ারি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। গ্রস হিসাবে নামে ২৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে।

গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ২০ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

আকুর দেনা শোধের আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

গত ১১ নভেম্বর আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গ্রস হিসাবে নেমেছিল ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে।

 এর পর রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় অর্থনীতির এই সূচক বাড়তে থাকে। আইএমএফের চলমান ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ছাড় করার শর্ত হিসেবে গত ডিসেম্বর শেষে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কেনার কারণেও রিজার্ভ বাড়তে থাকে।

২৪ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২০ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ওই দিন গ্রস হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার।

এর পর ২৯ ডিসেম্বর এশীয় উন্নয়ন তহবিলের (এডিবি) ৬০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তার ঋণ যোগ হওয়ায় রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

গত বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।

৮ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ আরও বেড়ে ২১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। গ্রস হিসাবে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

৯ জানুয়ারি আকুর দেড় বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। গ্রস হিসাবে নামে ২৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে।

এক বছর আগে গত বছরের ১৫ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার।

রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস হচ্ছে—রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ২৪ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি।

রেমিটেন্সে ধীরগতি পরবর্তী

রেমিটেন্সে ধীরগতি

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর