বছরের শুরুতে রেমিটেন্সে ধীরগতি, কমেছে রিজার্ভ
২৫ দিনে যে রেমিটেন্স এসেছে, মাসের বাকি ৬ দিনে এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক দাঁড়াবে ২০৭ কোটি ৮১ লাখ ডলার, যা হবে ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো যখন বার্তা দিচ্ছিল দুঃসংবাদের, তখন রেমিটেন্সই দেখাচ্ছিল আশা; এখন সেই প্রবাসী আয়েও দেখা দিয়েছে ধীরগতি। আর তাতে কমেছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ; ফের ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্সের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, নতুন বছরের প্রথম মাস এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সপ্তম মাস জানুয়ারির প্রথম ২৫ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৬৭ কোটি ৫৯ লাখ (১.৬৭ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ ২০ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা।
এই ২৫ দিনে প্রতিদিন গড়ে এসেছে ৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ৮১৭ কোটি টাকা।
অথত গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের প্রথম ২১ দিনেই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি ৭২ লাখ) ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছিল।
সেই ২১ দিনে প্রতিদিন গড়ে এসেছিল ৯ কোটি ৫৬ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ছিল ১ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা।
ডিসেম্বর মাসে মোট রেমিটেন্স আসে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল একক মাসের হিসাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। এর আগে এক মাসে এত রেমিটেন্স কখনই আসেনি।
এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বাধিক ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অঙ্কের রেমিটেন্স এসেছিল গত বছরের জুন মাসে, ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের নভেম্বরে রেমিটেন্স এসেছিল ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। প্রতিদিন গড়ে এসেছিল ৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ ডলার, আগস্টে ২২২ কোটি ৪১ লাখ ডলার, জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ডলার রেমিটেন্স আসে।
অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসের পাঁচ মাসই ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে দেশে। এর আগে কখনই এমনটা দেখা যায়নি।
গত বছরের মাঝামাঝিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা,মৃত্যু,ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমে গিয়েছিল।
ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিল।
সেই আন্দোলনে আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রেমিটেন্সে দেখা দেয় উল্লম্ফন। পাঁচ মাস পর এখন রেমিটেন্সে নিম্নমূখী ধারা দেখা যাচ্ছে।
জানুয়ারির ২৫ দিনে যে রেমিটেন্স এসেছে, মাসের বাকি ৬ দিনে (২৬ থেকে ৩১ জানুয়ারি) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক দাঁড়াবে ২০৭ কোটি ৮১ লাখ (২.০৭ বিলিয়ন) ডলার, যা হবে ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
রিজার্ভ ফের ২০ বিলিয়নের নিচে নেমেছে
দেশের অর্থনীতির আলোচিত সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটছে না। ফের ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।
গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ২৩ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে ১৫ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। দুই সপ্তাহ আগে ৮ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে নেমেছিল ২৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে।
এক মাস পর ২৩ জানুয়ারি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২০ বিলিয়নের নিচে নেমেছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। পরের সপ্তাহে ২৪ ডিসেম্বর তা বেড়ে ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়নে ওঠে।
রোজার মাসকে সামনে রেখে পণ্য আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভ কমেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এর আগে গত নভেম্বর আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গ্রস হিসাবে নেমেছিল ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে।
এর পর রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় এই সূচক বাড়তে থাকে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলমান ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ছাড় করার শর্ত হিসেবে গত ডিসেম্বর শেষে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কেনার কারণেও রিজার্ভ বাড়তে থাকে।
২৪ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২০ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ওই দিন গ্রস হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার।
এর পর ২৯ ডিসেম্বর এশীয় উন্নয়ন তহবিলের (এডিবি) ৬০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তার ঋণ যোগ হওয়ায় রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
গত বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি ব্যয় কমায় এবং রেমিটেন্স বাড়ায় ২০২১ সালের আগস্টে বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গ্রস হিসাবে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আমদানি খরচ দুই থেকে আড়াই গুণ বেড়ে যায়। এর পর থেকে কমতে থাকে রিজার্ভ।
গত দুই বছরে বেশ কয়েকবার বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ নেমেছে ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
এক বছর আগে গত বছরের ২২ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।
২০২৩ সালের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথা মতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রস হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এর আগে কেবল গ্রস হিসাবের তথ্যই প্রকাশ করা হতো।
এখন বিপিএম-৬ ও গ্রস হিসাবের পাশাপাশি রিজার্ভের নিট বা প্রকৃত হিসাবও করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সেটি প্রকাশ করা হয় না। কেবল আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থাকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
নিট রিজার্ভ হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মোট সঞ্চিতি থেকে সব ধরনের দায়দেনা বাদ দেওয়ার পর যা থাকে সেটা। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে গ্রস হিসাবের রিজার্ভের চেয়ে নিট রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো কম থাকে। আর বিপিএম-৬ হিসাবের চেয়ে কম থাকে ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো।
সে হিসাবে বাংলাদেশের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের কম।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হিসেবে দাবি করে।
সবশেষ গত নভেম্বর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুদ থাকতে হয়।
কমেন্ট