রেমিটেন্সের নামে ৭৩০ কোটি টাকা দেশে এনেছেন এক ব্যক্তি, এনবিআর চেয়ারম্যানের চাঞ্চল্যকর তথ্য

রেমিটেন্সের নামে ৭৩০ কোটি টাকা দেশে এনেছেন এক ব্যক্তি, এনবিআর চেয়ারম্যানের চাঞ্চল্যকর তথ্য

সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও বিসিএস কর ক্যাডারদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানান এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান।

বৈধপথে প্রবাসী আয় (রেমিটেন্স) পাঠানোকে উৎসাহিত করতে করমুক্ত সুবিধা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে নগদ প্রণোদনাও দেওয়া হয়। আর এই করমুক্ত ও নগদ প্রণোদনার সুযোগ নিয়ে এক ব্যবসায়ী ৭৩০ কোটি টাকা দেশে এনেছেন বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান।

সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও বিসিএস কর ক্যাডারদের এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। তবে ওই ব্যক্তির নাম, পরিচয় ও ঘটনার সময় উল্লেখ করেননি তিনি।

গত কয়েক মাস ধরে রেমিটেন্স প্রবাহে যে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে এই ব্যবসায়ীর মতো আরও অনেকে কর ও প্রণোদনা সুবিধা নিয়ে রেমিটেন্সের নামে দেশে টাকা এনেছেন বলে ধারনা করছেন অনেকে। পাচার করা টাকা প্রণোদনার সুবিধা নিয়ে অনেকে দেশে ফেরত অোনছে বলে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময়েও অর্থনীতিবিদরা সংশ্রয় প্রকাশ করেছিলেন।

‘রেমিটেন্সের নামে ৭৩০ কোটি টাকা দেশে এনেছেন এক ব্যক্তি’ এনবিআর চেয়ারম্যানের এই বক্তব্য বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচার হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে।

কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর তার ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, “রেমিটেন্সের এতো সমারোহের পেছনে তাহলে এই? আর কে কতো এনেছে—তার হিসাবটা কী পাওয়া যাবে!”

সোমবারের মতবিনিময় সভায় প্রবাসী আয়ের নামে এক ব্যক্তির এত বিপুল অর্থ আনার বিষয়টি কর কর্মকর্তাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করেছে বলে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। ওই ব্যক্তির নাম–পরিচয় জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, “নাম না বলাই ভালো। ব্যবস্থা তো নিতে হবে। ব্যবস্থা নেওয়ার পরে এমনিতেই আপনারা নাম জেনে যাবেন।”

মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মহিদুল হাসান।

বর্তমানে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে করমুক্তি সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়া প্রবাসী আয়ে সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে যার নামে টাকা আসে তিনি ওই ১০০ টাকার সঙ্গে আরও ২ টাকা ৫০ পয়সা পান।

নিয়মের ব্যত্যয় করে এই সুবিধা ওই ব্যবসায়ী নিয়েছেন বলে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। 

দেশে প্রত্যক্ষ কর বাড়লেও অর্থনৈতিক বৈষম্য না কমে বাড়ছে কেন—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অনুষ্ঠানে আবদুর রহমান খান বলেন, যেসব প্রবাসী ভাইয়েরা কঠোর পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে পাঠান, তাদের সেই আয় করমুক্ত হবে। এ জন্য আইন করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে প্রবাসীদের উৎসাহ দিতে।

“কিন্তু আইনকানুনের ব্যত্যয় করে সেই সুবিধার আড়ালে কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।”

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “শুনলে আশ্চর্য হবেন, এমন করদাতা পাওয়া গেল, যিনি ৭৩০ কোটি টাকা নিয়ে এলেন। ওই ব্যক্তি বলছেন, সেটা এটা ওয়েজ আর্নার্স ও তা করমুক্ত। এই যে আপনারা প্রশ্ন করলেন কেন ‘গিনি সহগ’ উল্টো দিকে হাঁটছে, তার কারণ হচ্ছে এই।”

আবদুর রহমান খান আরও বলেন, “হয় আমরা এগুলো দেখিনি, অথবা বুঝিনি। অথবা দেখেও না দেখার ভান করছি। তাদের আমরা সুযোগ দিচ্ছি। এগুলোই আমাদের বড় সমস্যা।”

অনলাইন আয়কর রিটার্ন বা ই-রিটার্ন প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আইনকানুন হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। ১ কোটি ১৩ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনধারী রয়েছেন। কিন্তু রিটার্ন দেন ৪০ লাখ করদাতা। বাকি ৮০ লাখের বেশি মানুষ রিটার্ন দেন না।

“ভবিষ্যতে ব্যাংকের সঙ্গে এপিআইয়ের (অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস) মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করের তথ্য নেওয়া হবে। এর মাধ্যমে করদাতার আমানত কত, কত টাকা উৎসে কর কাটা হয়েছে প্রভৃতি মৌলিক তথ্য রিটার্ন জমার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে।”

সভায় ইআরএফ সভাপতি দৌলত আক্তার মালা করদাতাদের ভয়ভীতি দূর করার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ও আমদানি-রপ্তানিসহ করসংক্রান্ত সব হালনাগাদ তথ্য নিয়মিত অনলাইনে প্রকাশের অনুরোধ জানান।

দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ঢল নেমেছে। প্রতি মাসেই বাড়ছে প্রবাসী আয়।

এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সাত মাসেই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এমনটা দেখা যায়নি।

জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মোট ১ হাজার ৮৪৮ কোটি ৮৭ লাখ (১৮.৪৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি।

রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে পরিবার-পরিজনের বাড়তি খরচ মেটাতে বেশি বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত রবিবার রেমিটেন্সের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, নতুন বছরের তৃতীয় মাস এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের নবম মাস মার্চের ১৫ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৬৫ কোটি ৬১ লাখ (১.৬৫ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন।

বর্তমান বিনিময় হার (রেমিটেন্স প্রতি ডলার ১২৩ টাকা) হিসাবে এই অর্থের পরিমাণ ২০ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ১১ কোটি শূন্য চার লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ৩৫৮ কোটি।

মাসের বাকি ১৬ দিন (১৬ থেকে ৩১ মার্চ) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক প্রায় ৩৫০ কোটি (৩.৫ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে ঠেকবে, যা হবে একক মাসের হিসাবে সবচেয়ে বেশি।

গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল এক মাসে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ।

সব মিলিয়ে চলতি অর্থ বছরের সাড়ে আট মাসে (২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ১৫ মার্চ) ২ হাজার ১৫ কোটি (২০.১৫ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে।

বাকি সাড়ে তিন মাসে (১৬ মার্চ থেকে ৩০ জুন) এই হারে এলে এবার অর্থ বছর শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২৮ বিলিয়ন (২ হাজার ৮০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে হিসাব বলছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশা করছেন, জুন মাসে দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে। ওই ঈদকে ঘিরেও বেশি রেমিটেন্স পাঠাবেন প্রবাসীরা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থ বছরে মোট রেমিটেন্সের অঙ্ক সাড়ে ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে; যা হবে রেকর্ড।

২০২৩-২৪ অর্থ বছরের পুরো সময়ে এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে এসেছিল ২২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার।

২০২০-২১ অর্থ বছরে আসে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল অর্থ বছরের হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স।

২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।

সাড়ে ৮ মাসেই ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল রেমিটেন্স পরবর্তী

সাড়ে ৮ মাসেই ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল রেমিটেন্স

কমেন্ট