মাস না পেরোতেই রেমিটেন্সে রেকর্ড, ২৬ দিনেই এল প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার
মাসের বাকি ৫ দিনে (২৭ থেকে ৩১ মার্চ) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ৩৫০ কোটি (৩.৫০ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে পৌঁছবে বলে বলে হিসাব বলছে।
ঈদ সামনে রেখে পরিবার-পরিজনের বাড়তি খরচ মেটাতে বেশি বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। এ কারণে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ঢল নেমেছে।
মার্চ মাস শেষ হতে এখনও কয়েক দিন বাকি; এরই মধ্যে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রায় ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা।
এর আগে এক মাসের পুরো সময়েও ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স দেশে আসেনি।
গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল এক মাসে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার রেমিটেন্সের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, নতুন বছরের তৃতীয় মাস এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের নবম মাস মার্চের ২৬ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৯৪ কোটি (২.৯৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
এই অঙ্ক গত বছরের মার্চ মাসের ২৬ দিনের চেয়ে ৮২ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি; আর পুরো মাসের চেয়ে বেশি ৪৭ শতাংশ।
২০২৪ সালের মার্চের ২৬ দিনে ১৬১ কোটি (১.৬১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা; পুরো মাসে এসেছিল ১৯৯ কোটি ৭০ লাখ (প্রায় ২ বিলিয়ন) ডলার।
প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে ১২৩ টাকা টাকা দিচ্ছে এখন ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে মার্চ মাসের ২৬ দিনে ৩৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ১১ কোটি ৩১ আট লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ৩৯০ কোটি।
মাসের বাকি ৫ দিনে (২৭ থেকে ৩১ মার্চ) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ৩৫০ কোটি (৩.৫০ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে পৌঁছবে বলে বলে হিসাব বলছে।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে চলতি মাসের শেষ দিন ৩১ মার্চ অথবা ১ এপ্রিল ঈদ উদযাপিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের আগে আগে আরও বেশি রেমিটেন্স পাঠাবেন প্রবাসীরা। আর সেটা যদি হয়, তাহলে মার্চ মাসে রেমিটেন্স সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
এমনিতেই প্রবাসী আয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মধ্যে সাত মাসেই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে দেশে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এমনটা দেখা যায়নি।
জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মোট ১ হাজার ৮৪৮ কোটি ৮৭ লাখ (১৮.৪৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থ বছরের আট মাস ২৬ দিনে (২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ২৬ মার্চ) ২ হাজার১৪৩ কোটি (২১.৪৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে।
অর্থ বছরের বাকি সময়ে (২৭ মার্চ থেকে ৩০ জুন) এই হারে এলে অর্থ বছর শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২৮ বিলিয়ন (২ হাজার ৮০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে হিসাব বলছে।
আগামী জুন মাসে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশা করছেন, ওই ঈদ ঘিরেও বেশি রেমিটেন্স পাঠাবেন প্রবাসীরা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থ বছরে মোট রেমিটেন্সের অঙ্ক সাড়ে ২৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে; যা হবে আরেকটি রেকর্ড।
রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ছাড়াল
এদিকে রেমিটেন্স বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ খানিকটা বেড়েছে; ফের ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
গত মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।
গত ১০ মার্চ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে; গ্রস হিসাবে নামে ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
আকুর বিল শোধের আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।
আকু হলো এশিয়ার কয়েকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যকার একটি আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, তার মূল্য প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি করা হয়।
অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়।
আকুর সদস্যদেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ।
আকুর সদস্যদেশগুলোর মধ্যে ভারত পরিশোধ করা অর্থের তুলনায় অন্য দেশগুলো থেকে বেশি পরিমাণে ডলার আয় করে। অন্যদিকে বেশিরভাগ দেশকেই আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় হিসেবে অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হয়।
৯ মাসের ৮ মাসই ২ বিলিয়নের বেশি রেমিটেন্স
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের নয় মাস শেষ হতে চলেছে। এই নয় মাসের আট মাসই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে দেশে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এমনটি দেখা যায়নি।
২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৭ কোটি ৪ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ছিল ৮৬০ কোটি টাকা।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে এসেছিল। টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৩২ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ৫১ লাখ ডলার; টাকায় ছিল এক হাজার ৩৯ কোটি টাকা।
চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে তারা পাঠান ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার।
চতুর্থ মাস অক্টোবরে আসে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার। পঞ্চম মাস নভেম্বরে এসেছিল ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার।
৯ মাস শেষ না হতেই ২১ বিলিয়ন ছাড়াল
সব মিলিয়ে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের আট মাস ২৬ দিনে (২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২৬ মার্চ) প্রবাসীরা ২ হাজার ১৪৩ কোটি (২১.৪৩ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের পুরো সময়ে (জুলাই-জুন) এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।
২০২২-২৩ অর্থ বছরে এসেছিল ২২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার।
২০২০-২১ অর্থ বছরে আসে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল অর্থ বছরের হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল। চলতি অর্থ বছরের আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মধ্যে কেবল জুলাই মাসেই ২ বিলিয়ন ডলারের কম রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। পরের সাত মাসেই (আগস্ট-ফেব্রুয়ারি) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে।
জুলাইয়ের আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারির সময়ে আমদানি তলানিতে নামায় একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ব বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সঙ্গে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।
সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই সূচকে।
কমেন্ট