রেমিটেন্সে ইতিহাস, মার্চে এল ৩ বিলিয়নেরও বেশি

রেমিটেন্সে ইতিহাস, মার্চে এল ৩ বিলিয়নেরও বেশি

এর আগে কোনও মাসেই ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসেনি। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল এক মাসে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ।

অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে অনন্য রেকর্ড হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক মাসে রেমিটেন্সের অঙ্ক ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্সের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, নতুন বছরের তৃতীয় মাস এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের নবম মাস মার্চে ব্যাংকিং চ্যানেলে ৩২৯ কোটি (৩.২৯ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি।

২০২৪ সালের মার্চে ১৯৯ কোটি ৭০ লাখ (প্রায় ২ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

এর আগে কোনও মাসেই ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসেনি। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল এক মাসে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ।

প্রতি বছরই রোজা ও দুই ঈদের আগে রেমিটেন্স বাড়ে। তবে এবারের রেজার ঈদে বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।

মার্চে রেমিটেন্স ৩ বিলিয়ন ছাড়াবে- এটা আগেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল।

ঈদের আগে মাস মার্চের ২৬ দিনে (১ থেকে ২৬ মার্চ) ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৯৪ কোটি (২.৯৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠান প্রবাসীরা। মাসের বাকি ৫ দিনে (২৭ থেকে ৩১ মার্চ) এসেছে ৩৫ কোটি ডলার।

সব মিলিয়ে মার্চে ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে।

প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে ১২৩ টাকা টাকা দিচ্ছে এখন ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে মার্চ মাসে ৪০ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ১০ কোটি ৬১ আট লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা।

গত বছরের মারেচ প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ কোটি ৪৪ আট লাখ ডলার।

এমনিতেই প্রবাসী আয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) মধ্যে আট মাসেই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে দেশে; মার্চে এসেছে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনো এমনটা দেখা যায়নি।

মাসেই প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার

সব মিলিয়ে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে মোট ২ হাজার ১৭৭ কোটি ৮৭ লাখ (২১.৭৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি।

গত অর্থ বছরে ১৭ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

আগামী জুন মাসে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশা করছেন, ওই ঈদ ঘিরেও বেশি রেমিটেন্স পাঠাবেন প্রবাসীরা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থ বছরে মোট রেমিটেন্সের অঙ্ক ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে; যা হবে আরেকটি রেকর্ড।

২০২৩-২৪ অর্থ বছরের এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।

২০২২-২৩ অর্থ বছরে এসেছিল ২২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এসেছিল ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার।

২০২০-২১ অর্থ বছরে আসে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল অর্থ বছরের হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স।

২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।

মাসের মাসই বিলিয়নের বেশি

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছর শুরু হয়েছিল গত বছরের জুলাই থেকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে ওই মাস ছিল উত্তাল; দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। কয়েক দিন ব্যাংক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল।

সে কারণে জুলাই মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ কিছুটা কমেছিল; এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ কোটি (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার। তার আগের তিন মাস অবশ্য ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি এসেছিল।

তবে তার পর থেকে প্রতি মাসেই ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে; মার্চে এসেছি তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি।

অর্থাৎ চলতি অর্থ বছরের নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) আট মাসেই (আগস্ট-মার্চ) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এমনটি দেখা যায়নি।

২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৭ কোটি ৪ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ছিল ৮৬০ কোটি টাকা।

গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে এসেছিল। টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৩২ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ৫১ লাখ ডলার; টাকায় ছিল এক হাজার ৩৯ কোটি টাকা।

চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে তারা পাঠান ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার।

চতুর্থ মাস অক্টোবরে আসে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার। পঞ্চম মাস নভেম্বরে এসেছিল ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার।

সহিংসতার কারণে কমেছিল জুলাইয়ে

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল।

জুলাইয়ের আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।

ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।

দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারির সময়ে আমদানি তলানিতে নামায় একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ব বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সঙ্গে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।

সঙ্কট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই সূচকে।

রিজার্ভ ২০.৩৫ বিলিয়ন ডলার

রেমিটেন্স বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেড়েছে; ফের ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

সবশেষ ২৮ মার্চের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওইদিন বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।

গত ১০ মার্চ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে; গ্রস হিসাবে নামে ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে।

আকুর বিল শোধের আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।

আকু হলো এশিয়ার কয়েকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যকার একটি আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, তার মূল্য প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি করা হয়।

অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়।

আকুর সদস্যদেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ।

আকুর সদস্যদেশগুলোর মধ্যে ভারত পরিশোধ করা অর্থের তুলনায় অন্য দেশগুলো থেকে বেশি পরিমাণে ডলার আয় করে। অন্যদিকে বেশিরভাগ দেশকেই আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় হিসেবে অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হিসেবে দাবি করে।

সবশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে প্রায় তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুদ থাকতে হয়।

মাস না পেরোতেই রেমিটেন্সে রেকর্ড, ২৬ দিনেই এল প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার পরবর্তী

মাস না পেরোতেই রেমিটেন্সে রেকর্ড, ২৬ দিনেই এল প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার

কমেন্ট