ডলার বিক্রি চলছে, রিজার্ভ কমছেই
ডলারের অস্থির বাজার সুস্থির করতে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে এই বিক্রি ১৩ বিলিয়ন ডলার ছুঁতে চলেছে।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ১ জুন) ১২ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে কোনো অর্থবছরের পুরো সময়ে (১২ মাস, জুলাই-জুন) বা কোনো ক্যালেন্ডার বছরে রিজার্ভ থেকে এত বেশি ডলার বিক্রি করা হয়নি।
আর এই বিক্রির ফলে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর সূচক রিজার্ভ আরও কমেছে। বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার; একদিন আগে বুধবার ছিল ২৯ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দর আরও দেড় টাকা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার থেকে ১০৬ টাকা দরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এতদিন প্রতি ডলারের জন্য ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা নেয়া হতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “চলতি বছরের ৪ মে থেকে প্রতি ডলার ১০৪ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করা হচ্ছিল। তা ১ টাকা ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১০৬ টাকা করা হয়েছে।”
তবে সব ব্যাংক এই দরে ডলার পাচ্ছে না। সরকারের প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্য ব্যাংকগুলোকে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে আমদানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
এদিন আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১০৮ টাকা, সর্বনিম্ন ছিল ১০৭ টাকা ৬৫ পয়সা। সব ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সঞ্চিত রিজার্ভ আরও কমে যাবে-সে জন্য সরকারের প্রয়োজনেই শুধু রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড়া হচ্ছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আন্তব্যাংক ও গ্রাহক পর্যায়ে সব ব্যাংকই বর্তমানে ভাসমান বিনিময় দর অনুসরণ করছে। তবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে নিজেদের নির্ধারিত আলাদা দর অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাকে বলা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সেলিং রেট’।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করত, সেটিকে ‘ইন্টার ব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেট’ বা ‘আন্তব্যাংক লেনদেন হার’ নামে অভিহিত করা হতো। ব্যাংকগুলোর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে দরে ডলার বিক্রি করত, তখন সেই দরকেই ডলার রেট ধরা হতো।
তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী বিদেশি ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ডলারের দর নির্ধারণ করছে।
বুধবার এবিবি-বাফেদা সভায় ডলারের নতুন দর নির্ধারণ করা হয়। প্রতি ডলার রেমিট্যান্স ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা এবং রপ্তানি পরিশোধের বিল ১০৭ টাকা করা হয়।
বাফেদা-এবিবির এই সিদ্ধান্তের ঠিক একদিন পর বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার সেলিং রেট বাড়ায়।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। এরপর থেকেই কমছে রিজার্ভ। এক বছর আগে ৩১ মে রিজার্ভ ছিল ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানি কমায় এবং রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ওই অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক
মে মাসে রেমিটেন্স কমেছে ১০ শতাংশ
এদিকে রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্স প্রবাহে সুখবর নেই। সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার (১.৬৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
এই অঙ্ক গত এপ্রিল মাসের চেয়ে দশমিক ৪ শতাংশ বেশি হলেও গত বছরের মে মাসের চেয়ে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কম।
এপ্রিল মাসে ১৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত বছরের মে মাসে এসেছিল ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
গত মার্চ মাসে ২০২ কোটি ২৫ লাখ (২.০২ বিলিয়ন) ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল দেশে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। পরের মাস আগস্টে আসে কিছু কম, ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার। এর পরের ছয় মাসের কোনো মাসেই প্রবাসী আয় ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) সব মিলিয়ে ১৯ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।
সংকটের এই সময়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে রেমিট্যান্স। কেননা, এই সূচকের বাড়া-কমার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে রিজার্ভের উত্থান-পতন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।
তবে বেশ উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর; প্রথম মাস জুলাইয়ে ২১০ কোটি (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার।
পরের মাস সেপ্টেম্বরে হোঁচট খায়; এক ধাক্কায় নেমে আসে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে। অক্টোবরে তা আরও কমে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে নেমে আসে।
পরের তিন মাস টানা বেড়েছে; নভেম্বরে আসে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। ডিসেম্বরে আসে ১৭০ কোটি ডলার। আর ২০২৩ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আসে আরও বেশি, ১৯৬ কোটি ডলার। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা বেশ কমে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলারে নেমে আসে।
রিজার্ভ ২৯.৮ বিলিয়ন ডলার
আমদানি ব্যয় কমছেই; এরপরও রিজার্ভ বাড়ছে না। রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সে ধীরগতি এবং ডলার বিক্রির কারণেই রিজার্ভ কমছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
আইএমএফের পর বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তার ৫০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ রিজার্ভে যোগ হয়েছে। এরপরও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না।
গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। মাঝে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণে ভর করে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উঠেছিল। গত কয়েক দিন ধরে তা ফের ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে অবস্থান করছে।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। এরপর থেকেই কমছে রিজার্ভ। এক বছর আগে ৩১ মে রিজার্ভ ছিল ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
কমেন্ট