বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ এখন ‘গলার কাঁটা’

বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ এখন ‘গলার কাঁটা’

ফাইল ছবি

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। দুই বছরের করোনা মহামারি আর এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বেশ চাপে পড়া অর্থনীতির জন্য এই বিদেশি ঋণ এখন বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এক হিসাব দিয়ে বলেছে, চলতি ২০২৩ সালে বেসরকারি খাতের ঋণের সুদ-আসল বাদ ১৬২ কোটি ৪০ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১০৯ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৭ হাজার ৭০১ কোটি টাকা।

এমন একটা সময় এই বড় অঙ্কের কিস্তি শোধ করতে হচ্ছে, যখন দেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ কমতে কমতে ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। রিজার্ভের যে এই পতন, তাতে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ একটি কারণ বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারা।

বাংলাদেশের ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সমষ্টিগত ভাবে ২৫ দশমিক ৯৫ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে, যা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি।

এই ঋণের মধ্যে স্বল্পকালীন ঋণ ছিল ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এসব স্বল্পকালীন ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩ বছর।

তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় গত এক বছরে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বিদেশি ঋণ খুব একটা নেননি।

অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বল্পকালীন বিদেশি ঋণ পরিশোধের ফলে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। এমনিতেই বেশ নাজুক অবস্থায় আছে; বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক রিজার্ভ ৪৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উঠে গিয়েছিল; এক বছর আগেও ছিল ৪২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।

এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে হিসাব করলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠিত ৭ বিলিয়ন ডলার ইডিএফের (রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল) আকার ধাপে ধাপে কমিয়ে রিজার্ভ বাড়াতে হবে। সেই শর্ত মেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইডিএফের আকার কমিয়ে ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে এনেছে।

একইসঙ্গে আরও কয়েকটি তহবিল এবং শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ২০ কোটি ডলার ঋণ এবং দু-তিনটি প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে দেয়া ১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে আলাদা করে নিট রিজার্ভের হিসাব করার শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ।

কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলেছিল, কোনো দেশের আপৎকালীন সংকট মেটানোর জন্য রিজার্ভ রাখা হয়। কিন্তু রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন তহবিল এবং প্রকল্পে দেয়া ঋণ বাংলাদেশ চাইলেই যখন-তখন খরচ করতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার আইএমএফের এই শর্ত মেনে নিয়েছে।

চলতি জুন থেকেই আইএমএফের শর্ত মেনে নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এসব শর্ত মানতে গিয়েই ইডিএফের আকার কমানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

সে হিসাবেই ইডিএফের ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এবং অন্য তহবিল ও প্রকল্পের ১ বিলিয়ন ডলার মোট ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বাদ দিলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

এ বছর বিদেশি ঋণের সুদ-আসল শোধ করতে হবে ১৬২ কোটি ডলার

ডলার সংকটের মধ্যেই চলতি ২০২৩ সালে দেশের বেসরকারি খাতকে দীর্ঘমেয়াদী বিদেশি ঋণের কিস্তি বাবদ ১.৬২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের মূল (প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট) বাবদ শোধ করতে হবে ১.২৭ বিলিয়ন ডলার। সেইসঙ্গে ৩৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে সুদ বাবদ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ২০৪০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ সুদ পরিশোধ করতে হবে চলতি ২০২৩ সালে। ২০০৯ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত ৩১ বছরের হিসাবেও এটি সর্বোচ্চ পরিমাণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ আগের সময়ের তুলনায় হঠাৎ বেড়ে ১.৭৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এই বাণিজ্যিক ঋণের বেশিরভাগই পরিশোধ করতে হবে টেলিযোগাযোগ খাতকে। তবে প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, আগামী দশকগুলোতে এই ঋণ পরিষেবা ক্রমান্বয়ে কমে যেতে পারে।

এদিকে এত বেশি পরিমাণ বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক এবং দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান এইচ মনসুর।

এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন এই ঋণ নেয়, তখন ডলারের দর ছিল ৮৪/৮৫ টাকা বা তারও কম। এখন সেই ঋণের সুদ-আসল পরিশোধের জন্য ১১০ টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। বলা যায়, বড় বিপদেই পড়েছেন তারা।

“সুদের পাশাপাশি তাদের আরও বেশি চাপ নিতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে ডলারের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে এসব ঋণ দ্রুত পরিশোধের একটি প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে দিন যতো যাচ্ছে, বিদেশি ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ বাড়ছই।”

এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “কোন কোন ব্যাংক আমদানি করার জন্য ঋণপত্র খুলতে পারছে না। কারণ তাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডলার নেই। ফলে এত বড় অর্থ পরিশোধ করা অবশ্যই কঠিন। আবার ব্যবসায়ীরা চাইছেন দ্রুত ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে। কারণ তারা মনে করছেন সামনে ডলারের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। তারা টাকা দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু ব্যাংকগুলোর কাছে তো ডলার নেই। ফলে এক রকমের চাপের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।”

 

রিজার্ভ চুরি: প্রতিবেদন দিতে আরও ২ মাস সময় পেল সিআইডি পরবর্তী

রিজার্ভ চুরি: প্রতিবেদন দিতে আরও ২ মাস সময় পেল সিআইডি

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর