সংকটেও বাড়ছে এফডিআই, ৫ বিলিয়নের রেকর্ড ছোঁয়ার আশা

সংকটেও বাড়ছে এফডিআই, ৫ বিলিয়নের রেকর্ড ছোঁয়ার আশা

স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের আবহ তৈরি হয়েছে। ফাইল ছবি

দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই সোয়া বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো হোঁচট খেলেও বিদেশি বিনিয়োগ এখনও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বিদেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৪২০ কোটি ১০ লাখ (৪.২০ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে দেশে।

এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই দশ মাসে ৩৮৯ কোটি ৯০ লাখ (৩.৮৯ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ।

ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের যে আবহ তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব পড়ছে বিদেশি বিনিয়োগে। সংকটের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াকে দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বলছেন তারা। বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এফডিআই আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে এফডিআই বাড়লেও নিট এফবিআই কমেছে। বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে নিট এফডিআই কমেছে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। এই দশ মাসে ১৪৯ কোটি ডলারের নিট এফডিআই এসেছে দেশে। গত বছরের এই সময়ে এসেছিল ১৬৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ (৪.৭১ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআই বেড়েছিল আরও বেশি, ৬১ শতাংশ।

গত অর্থবছরে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৩৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট এফডিআই এসেছিল ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিন দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করায় বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেছে। রাজধানীতে মেট্রোরেল ছুটছে। চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হবে খুব শিগগির। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ১০-১২টির কাজ শেষের দিকে।”

“করোনা ও যুদ্ধের মধ্যেও মোটামুটি একটা ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি। অল্প সময়ের মধ্যে আইএমএফের ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। তাদের পরামর্শে বা কথামতো কিছু সংস্কার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এসবের ইতিবাচক প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগে পড়েছে।

“তাই আশা করা যাচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। তবে একটি দেশে বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। দেশে বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। সন্তোষজনক রিজার্ভ থাকতে হয়। বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ ও সরকারের নীতি-সহায়তা প্রয়োজন হয়।”

দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর বলেন, “বেশ কিছুদিন ধরে দেশে বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩০ থেকে ৩১ শতাংশের মধ্যে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছেই। দেশি বিনিয়োগ যদি বাড়ে, ডলারের বাজারের অস্থিরতা যদি কেটে যায় তাহলে দেশে দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগই বাড়বে।”

২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩.২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল দেশে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৩ কোটি ডলার।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ওই বছর। এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা।

বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে যে এফডিআই দেশে এসেছে, বছরের বাকি দুই মাসে (মে-জুন) সেই হারেও যদি আসে, তাহলে অর্থবছর শেষে মোট এফডিআইয়ের পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, যা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড।

বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে নিট এফডিআই বলা হয়।

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই দেশে বিনিয়োগের আবহ তৈরি হয়। গত বছরের ২৫ জুন বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। এই সেতু ঘিরে কয়েক মাস ধরে দেশে বিভিন্ন খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছিল। সে কারণেই শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি, পরিবহন খাতের বাস-ট্রাক তৈরির যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য খাতের সব ধরনের যন্ত্রপাতি-সরঞ্জামের আমদানি বেশ বাড়ছিল। সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।

কিন্তু সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানির লাগাম টেনে ধরতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ায় এখন আমদানি ব্যয় বেশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছিল ৪১ শতাংশের মতো। কিন্তু চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমেছে ৫০ শতাংশের মতো।

শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে। মধ্যবর্তী পণ্যের এলসিও কমেছে।

এদিকে নানা উদ্যোগের পরও কাটছে না ডলারসংকট। পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। বৃহস্পতিবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। এক বছর আগে এই রিজার্ভ ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশে আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ এআরএইচ ডটকমকে বলেন, ‘করোনার ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ ধাক্কা খেয়েছে। এ অবস্থায় দেশে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসবে- এমনটা প্রত্যাশা করা উচিত হবে না।’

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনো আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এ ছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এত দিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি। এগুলো ঠিক হলে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ আসবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একা বিনিয়োগ করে খুবই কম। দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। সে কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।”

এরশাদ আহমেদ বলেন, “নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ বিশ্ব অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। এই সেতু ঘিরে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবশ্যই বিদেশি বিনিয়োগও আসবে। তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্ব একটি কঠিন সময় পার করছে। এই সংকট কেটে গেলে বাংলাদেশে এফডিআই বাড়বে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে।’

অ্যামচেম সভাপতি বলেন, “গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বেশ ভালো বিকাশ হয়েছে। রপ্তানিও বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এ খাতে কিছু এফডিআই ইতিমধ্যে এসেছে। ভবিষ্যতে আরও আসবে বলে আশা করছি। সে ক্ষেত্রে কৃষি খাত বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন আশা জাগিয়েছে বলে আমি মনে করছি।”

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা যায়, আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতে কোরিয়া, চীন ও হংকং থেকে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, ব্যাংক, টেলিকমিউনিকেশন খাতেও কিছু বিনিয়োগ এসেছে।

আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। মূলধন হিসেবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি হিসেবে, বাংলাদেশে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা বিদেশে না নিয়ে পুনর্বিনিয়োগ করে এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। এই তিন পদ্ধতির যেকোনোভাবে দেশে বিনিয়োগ এলে তা এফডিআই হিসেবে গণ্য করা হয়।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের প্রায় ১৭ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ শতাংশের মতো বিনিয়োগ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডসের বিনিয়োগ ৮ শতাংশ। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, চীন, মিসর, যুক্তরাজ্য, হংকং এবং অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ রয়েছে।

২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ এই পাঁচ অর্থবছরে দেশে মোট ২৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ১৭ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।

 

 

 

বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ এখন ‘গলার কাঁটা’

পরবর্তী

বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ এখন ‘গলার কাঁটা’

কমেন্ট