রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি ১৩ বিলিয়ন ছাড়াল

রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি ১৩ বিলিয়ন ছাড়াল

ফাইল ছবি

বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে; গড়ছে রেকর্ডের পর রেকর্ড। অস্থির ডলারের বাজার সুস্থির করতে ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাস আট আট দিনে (২০২২ সালে ১ জুলাই থেকে চলতি জুন মাসের ৮ তারিখ) রিজার্ভ থেকে ১ হাজার ৩১১ কোটি (১৩.১১ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

এই অঙ্ক গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, জুলাই-জুন) চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। গত অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। আর এর ফলে কমেই চলেছে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক রিজার্ভ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কোনো বছর বা অর্থবছরের পুরো সময়েও (১২ মাস) রিজার্ভ থেকে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি। আমদানি কমায় এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের রেমিটেন্স বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ডলারের দর ধরে রাখতে উল্টো বাজার থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রী ব্যাংক।

আইএমএফের পর বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। অল্প দিনের ব্যবধানে এই দুই সংস্থার কাছ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে।

রোববার দিনের শুরুতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এক বছর আগে ২০২২ সালের ৭ জুন রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে এই রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

নতুন অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম মাস জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। কি পরিমাণ বিল শোধ করতে হবে, তা জানা যাবে জুন মাস শেষ হলে।

গত মার্চ-এপ্রিল মেয়াদে আকুর বিল ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। এবার যদি ১ বিলিয়ন ডলারও শোধ করা হয়, তাহলে রিজার্ভ নেমে আসবে ২৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। আর নিট রিজার্ভ নামবে ২৩ বিলিয়নের নিচে।

এদিকে রিজার্ভ ধরে রাখতে আপাতত দিনে ৬ কোটি ডলারের বেশি বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার-সংকটের কারণে বিদ্যুৎ-জ্বালানি উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বিদেশি এয়ারলাইন্সের আয় স্থানান্তর, ব্যক্তিগত ভ্রমণ, এমনকি বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য টিউশন ফি পরিশোধে নানা সংকটে পড়তে হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধে এ মুহূর্তে অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার দরকার। এসব প্রতিষ্ঠানের হাতে টাকা থাকলেও ডলার না পাওয়ায় বকেয়া পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে। সুযোগ পেয়েও শুধু ডলারের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে পারছেন না। এসব নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনেক অভিযোগ আসছে।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ যে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, তাতে বাজার থেকে ডলার কেনার অবদান ছিল বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। আবার এখন যে রিজার্ভ কমছে, তাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন এই অর্থনীতিবিদ।

করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে আমদানি বাড়তে শুরু করে; লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে অর্থনীতির এই সূচক। তাতে বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়, বাড়তে থাকে দাম। সেই চাহিদা মেটাতে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময় ধরে চলে এই বিক্রি। রিজার্ভ থেকে ডলার বাজারে না ছাড়লে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম আরও বেড়ে যাবে- এ বিবেচনায় ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রির মধ্য দিয়ে শেষ হয় ওই অর্থবছর।

গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে সব ব্যাংকের কাছে প্রয়োজনীয় ডলার বিক্রি করলেও গত কয়েক মাস মাস ধরে শুধু সরকারি কেনাকাটা ও জ্বালানি তেল, সারসহ অন্যান্য অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য এলসি বা ঋণপত্র খুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।

চাহিদা থাকায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দরও ধারাবাহিকভাবে বাড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১ জুন থেকে ১০৬ টাকা দরে এই ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে আমদানি খরচ মেটাচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৮ টাকা ৫১ পয়সা। অর্থাৎ যে ব্যাংকের ডলার প্রয়োজন হয়েছে, সে ব্যাংকগুলো এই দরে অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনে চাহিদা মিটিয়েছে।

বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। মহাসংকটে পড়ায় শ্রীলঙ্কা অবশ্য মাস দেড়েক আগে আকুর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। গত এপ্রিলে ৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে বর্তমানের নিট রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে চার মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে।

ডলার-সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তার পরও সংকট কাটছে না। ফলে জরুরি আমদানির দায় মেটাতেই রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দিতে হচ্ছে। তবু আটকে থাকছে কোটি কোটি ডলারের পণ্য। ডলার-সংকটে আমদানিকারকদের চাহিদা মেটাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। সে কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করলেও রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আট মাস ধরে শুধু সরকারি আমদানি ব্যয় মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, ‘আশার কথা হচ্ছে, মে মাসে রপ্তানি আয় ফের বেড়েছে। রেমিটেন্সের প্রবাহও মোটামুটি। এই দুই সূচক যদি না বাড়ত আর আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ পাওয়া না যেতো তাহলে কিন্তু রিজার্ভ আরও কমে যেত।”

“এখন কথা হচ্ছে, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আকুর বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ আরও কমে যাবে। তিন-চার মাসের মধ্যে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। একইসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ অন্যন্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে দ্রুত ঋণ পেতে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।”

“মনে রাখতে হবে, এই কঠিন সময়ে রিজার্ভ যদি আরও কমে যায়, তাহলে কিন্তু আমাদের বিপদ আরও বাড়বে,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসাস মনসুর।

“ডলারের অস্থির বাজারই আসলে আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সোয়া বছরে টাকার ২৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে। ৮৬ টাকার ডলার ১০৯ টাকায় উঠেছে। এক লাফে টাকার এই বড় অবমূল্যায়ন ধারণ করার মতো ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির ছিল না।

“আমরা সবচেয়ে বড় যে ভুলটা করেছিলাম, সেটা হলো দুই বছরের বেশি সময় আমরা টাকা-ডলারের বিনিময় হার ৮৪ টাকায় আটকে রেখেছিলাম। সেটা না করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ধীরে ধীরে যদি আমরা আমাদের টাকার অবমূল্যায়ন করতাম, তাহলে এত বড় ধাক্কা লাগত না।”

কমল ভোজ্যতেলের দাম, আরও কমতে পারে

পূর্ববর্তী

কমল ভোজ্যতেলের দাম, আরও কমতে পারে

জ্বালানি সংকট কাটাতে গ্যাস অনুসন্ধানের তাগিদ পরবর্তী

জ্বালানি সংকট কাটাতে গ্যাস অনুসন্ধানের তাগিদ

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর