আন্তঃব্যাংক লেনদেনে সর্বোচ্চ চূড়ায় ডলার
ফাইল ছবি
গত বছরের মার্চে দেশে মার্কিন ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা এখনো কাটেনি। অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পণ্য আমদানিতে তারা চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সেবা দিয়ে যে আয় ও মুনাফা করেছে, তা-ও নিজ দেশে নিতে পারছে না।
বাজারে চাহিদা বাড়লেও জোগান কমছে ডলারের। আর এতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে এই বিদেশি মুদ্রার দর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে উঠল ১০৯ টাকায়।
এক বছর আগে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে আন্তঃব্যাংকের যে দর বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার প্রকাশ করেছে, তাতে ডলারের এই দর দেখা যায়।
এর আগে গত ১৬ মে প্রথমবারের মতো আন্তঃব্যাংকে ডলারের দর উঠেছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। এরপর সামান্য কিছু বেড়ে ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত উঠে ফের ১০৮ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে অবস্থান করছিল মে মাসের শেষের দিকে।
চলতি জুন মাসে দুই সপ্তাহ ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০৮ টাকা ৮০ পয়সার মধ্যে লেনদেন হয়। বুধবার ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা। বৃহস্পতিবার তা এক লাফে ৩০ পয়সা বেড়ে ১০৯ টাকায় উঠেছে।
এক বছর আগে গত বছরের ৭ জুন এই দর ছিল ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে১৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
ডলারের এ দরের সঙ্গে ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে কমিশন আকারে ১০ থেকে ৫০ পয়সা পর্যন্ত যোগ করে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে ডলারের দর আরও বাড়ে।
বেসরকারি সিটি ব্যাংক বৃহস্পতিবার ১০৯ টাকা ৪৬ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করছে বলে তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ওয়েবসাইট বলছে, তারা ১০৯ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় দেশের ডলার উপার্জনের মূল ক্ষেত্র।
গত মে মাসে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা ২০২২ সালের মে মাসের চেয়ে ১৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম। গত বছরের মে মাসে রেমিটেন্স এসেছিল ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ মাসে গড়ে রেমিটেন্স এসেছে ১ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার।
আর গত এপ্রিলে মাস শেষে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে গড় রপ্তানি আয় ছিল ৪ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
অবশ্য গত মার্চ ও এপ্রিলে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকা রপ্তানি আয় মে মাসে ২৬ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা গিয়েছে।
অন্যদিকে গত এপ্রিলে মাস শেষে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে আমদানি খরচ গড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের এ খরচে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় সর্বশেষ গত ১ জুন রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ের বিপরীতে ডলারের দর ফের বাড়ায় বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশে ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন-বাফেদা।
নতুন দরে রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে পাওয়া যাবে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা, আর রপ্তানিকারকরা প্রতি ডলারের বিপরীতে ১০৭ টাকা পাবেন।
বর্তমানে আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও নগদ বিক্রিতে ডলারের দর ভিন্ন ভিন্ন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের পরার্মশ রয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক দর না রেখে একক দর রাখা।
পরামর্শ মেনে আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও নগদ কেনাবেচায় বিদেশি মুদ্রার একাধিক বিনিময় হারকে একটিতে নামিয়ে আনার প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; ১৮ জুন রোববার যে নতুন মুদ্রানীতি (জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের) ঘোষণা করা হবে, তাতে বিনিময় হার নির্ধারণের পদ্ধতি এবং তা বাস্তবায়নের বিষয়ে বিস্তারিত থাকবে বলেও জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ৭ মে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সমাপনী বৈঠকের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, একক হার মানে এই নয় যে সবক্ষেত্রে অর্থাৎ আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও নগদ কেনাবেচায় একটি বিনিময় হার হবে। তবে প্রতিটি দরের সঙ্গে আরেকটির পার্থক্য হবে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির ফলে আমদানি ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। ফলে নতুন করে ডলারের চাহিদা কমে গেছে। তবে আগে আমদানি হয়েছে এমন দায়, বিদেশি ঋণ পরিশোধ ও বিলম্বিত ঋণপত্রের দায় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। কারণ, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি না বাড়ায় ডলারের সরবরাহ বাড়েনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলো ডলারের কেনাবেচার দাম নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ফলে এই সীমার মধ্যে ডলারের দাম বাড়ছে। তবে এখন দাম বাড়ছে ধীরগতিতে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের কাছে ডলারের দাম ১১০ টাকার বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কারণ, ব্যাংকগুলোকে কিছু ক্ষেত্রে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
দীর্ঘদিন ডলারের বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “এত দিন টাকার মান ৪০ শতাংশ অতিমূল্যায়িত ছিল। ডলার-সংকট শুরু হওয়ার পর ২৫ শতাংশের মতো টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আরও ১৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন করতে হবে।”
তিনি বলেন, “দেরিতে হলেও ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা করলে একটা সমাধান হতে পারে। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য সর্বোচ্চ ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য বৈধ পথে আয় বাড়াতে হবে। তাহলে সংকটও কমবে।”
“অন্যদিকে সংকটের এই সময়ে রপ্তানি আয় যাতে না কমে সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে কম সুদের ঋণ আনার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) বাড়তে হবে।”
“আমাদের একটা বিষয় খুব ভালোভাবে মনে রাখতে হবে, বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। নানা ভুলের কারণে এই রিজার্ভ অনেক কমেছে; ৪৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।
“কিন্তু আর নয়, আর কমতে দেয়া যাবে না। যে করেই হোক আটকাতে হবে। তানাহলে কিন্তু আমরা বড় ধরনের বিপদে পড়বো,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
কমেন্ট