৩ দাতা সংস্থার সঙ্গে ১ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি, স্বস্তিতে সরকার
বুধবার ইআরডি সচিব শরিফা খান এবং এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিন্টিং ৪০ কোটি ডলার ঋণের চুক্তি সই করেন। ছবি: এআরএইচ ডটকম
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়াতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার; যার সুফলও মিলছে ভালোই।
এক দিনের ব্যবধানে তিন দাতা সংস্থার সঙ্গে কম সুদের প্রায় ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ চুক্তি সই করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি।
এরমধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে ১৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের ঋণের চুক্তি সই হয়েছে মঙ্গলবার। পরের দিন বুধবার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে ৪০ কোটি ডলারের চুক্তি সই হয়েছে। একই দিন একই পরিমাণ (৪০ কোটি ডলার) ঋণের চুক্তি সই হয়েছে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) সঙ্গে।
আগামী সপ্তাহেই এই বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভে যোগ হবে। আরেক উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকার সঙ্গেও দুই-একদিনের মধ্যে ২১ কোটি ৬০ লাখ ডলার ঋণের চুক্তি সই হবে বলে জানিয়েছেন ইআরডি কর্মকর্তারা।
আর এর মধ্য দিয়ে রিজার্ভে যে চাপ রয়েছে তা অনেকটাই কেটে যাবে বলে আশা করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে বলেও আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি।
বিশ্ব ব্যাংক
উচ্চ শিক্ষিতদের চাহিদাভিত্তিক দক্ষতা বাড়ানোর একটি প্রকল্পে বাংলাদেশকে ১৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের ঋণ দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক। এই ঋণের জন্য ০.৭৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ এবং ১.২৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। ৫ বছরের রেয়াতকালসহ ৩০ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে ইআরডি সম্মেলন কক্ষে এই ঋণের চুক্তি সই হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ইআরডি সচিব শরিফা খান এবং বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুলায়ে সেক চুক্তিতে সই করেন। দুই দিনের ঢাকা সফরে আসা বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজারও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
ইআরডি জানায়, ‘হায়ার এডুকেশন একসেলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন’শীর্ষক প্রকল্পের জন্য এই ঋণ সহায়তা দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক।
বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এই প্রকল্পটি আগামী ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে।
দেশের উচ্চ শিক্ষিতদের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এবং নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।
বাজার চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষা কোর্স প্রবর্তন, উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল সংযোগ বৃদ্ধি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা প্রকল্পটির অন্যতম উদ্দেশ্য।
এছাড়া প্রকল্পটির মাধ্যমে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের জন্য অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণ এবং মহিলা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ঋণদাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ পর্যন্ত মোট ৩৬০ কোটি ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটি এক বছরে বাংলাদেশের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের সর্বোচ্চ অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি।
এডিবি
রাজস্ব আহরণ এবং সরকারি ব্যয়ের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহযোগিতায় বাংলাদেশের জন্য ৪০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে এডিবি।
মঙ্গলবার ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলায় সংস্থাটির বোর্ড সভায় এই ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়। একদিনের ব্যবধানে বুধবার এই ঋণের চুক্তি সই হয়েছে বলে এডিবি ঢাকা অফিসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
ইআরডি অফিসে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ইআরডি সচিব শরিফা খান এবং এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিন্টিং চুক্তিতে সই করেন।
করোনা মহামারির সময়ে ২০২১ সালের অক্টোবরে চালু করা ‘সাসটেইনেবল ইকোনমিক রিকভারি প্রোগ্রাম’ এর আওতায় এই ঋণ দিচ্ছে ম্যানিলাভিত্তিক সংস্থাটি।
এডিবি জানিয়েছে, দেশীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সংস্কার, সরকারি ব্যয়ে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ছোট ব্যবসা, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের স্বল্প খরচে ঋণ পেতে সহায়তায় এই অর্থ দেওয়া হচ্ছে।
এডিবি বলেছে, নতুন আয়কর আইন কার্যকরের মাধ্যমে আয়কর সংগ্রহ বাড়ানোর পাশাপাশি কর আহরণ পদ্ধতির ত্রুটিগুলি কমিয়ে, নিয়ম মেনে চলার সংস্কৃতি ও আইন প্রয়োগের পদ্ধতিকে শক্তিশালী করে করজাল আরও বিস্তৃত করতে সহায়ক হবে এই ঋণ।
বাজেট সহায়তা হিসেবে এই ঋণ দিচ্ছে এডিবি।
এডিবি ঢাকা অফিসের বহিঃসম্পর্ক বিভাগের প্রধান গোবিন্দ বর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “চুক্তি সইয়ের এক-দুই দিনের মধ্যেই এডিবির ঋণ ছাড় করা হয়। সে হিসাবে বৃহস্পতিবার অথবা আগামী সপ্তাহের শুরুতেই এই ঋণের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে জমা হবে।”
এআইআইবি
অন্যদিকে চলমান সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশকে ৪০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা দিচ্ছে এআইআইবি। চীনভিত্তিক ব্যাংকটির সঙ্গে এই ঋণের চুক্তিও সই হয়েছে বুধবার।
ইআরডি সচিব শরীফা খান ও এআইআইবির ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইনভেস্টমেন্ট অপারেশন) উরিজিত আর প্যাটেল এই চুক্তিতে সই করেন।
সাসটেইনেবল ইকোনমিক রিকভারি প্রোগ্রাম (সাব প্রোগ্রাম-২) কর্মসূচির আওতায় বাজেট সাপোর্ট হিসেবে এ ঋণ নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে ইআরডি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, চীনে অবস্থিত এআইআইবির প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ চুক্তি হয়েছে।
এ ঋণের অর্থ কোভিড ১৯ ও বিশ্বব্যাপী চলমান আর্থিক অস্থিতিশীলতার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ব্যবহৃত হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
তিন বছরের রেয়াতকালসহ ঋণ পরিশোধের সময় ধরা হয়েছে ২৬ বছর। ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে সোফর (সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট) এর সঙ্গে ভেরিয়েবল স্প্রেড এক দশমিক ১৪ শতাংশ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কোভিড ১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি নানাবিধ বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, বাণিজ্য ঘাটতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নসহ নানা সংকটে পড়েছে দেশের অর্থনীতি।
এমন প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় এআইআইবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী বাজেট সহায়তা দিতে সম্মতি দিয়েছে।
এই ৪০ কোটি ডলারসহ এআইআইবি থেকে তিন বছরে ১৪৫ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা পেল বাংলাদেশ।
জাইকা দেবে ২১.৬০ কোটি ডলার
এছাড়া ২১ কোটি ৬০ লাখ ডলার ঋণ-সহায়তা দেবে জাইকা। এই ঋণও দু-একদিনের মধ্যে অনুমোদন পাবে সংস্থাটির বোর্ড সভায়। তার পর চুক্তি সই হবে।
চুক্তি সইয়ের পর পরই জাইকার সহায়তার এই অর্থ রিজার্ভে জমা হবে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আমি পরিস্কারভাবে একটা কথা বলতে চাই। আমাদের অর্থনীতিতে চাপ আছে; কিন্তু সংকট নেই। এই চাপ কাটিয়ে উঠতে আমরা নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি।”
“তারই অংশ হিসেবে আমরা কম সুদের ঋণের জন্য দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করি। তার সুফল এখন পাচ্ছি। সবার কাছ থেকেই কাঙ্খিত ঋণ-সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের রিজার্ভে যে চাপ দেখা দিয়েছে, তা কেটে যাবে বলে আশা করছি।”
কমেন্ট