রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নের নিচে নামল
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ফের ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
গত বুধবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। বৃহস্পতিবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ১ বিলিয়ন (১০৯ কোটি ৬০ লাখ) ডলার পরিশোধ করা হয়েছে।
আর এর ফলেই দিন শেষে রিজার্ভ কমে ২৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আকুর ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমানে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে।”
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন এবং কয়েকটি দাতাসংস্থার কাছ থেকে ঋণ-সহায়তা পাওয়ায় কোরবানি ঈদের আগে ২৫ জুন রিজার্ভ বেড়ে ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।
তার আগে এই সূচক কমতে কমতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে, ২৯ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
এর আগে গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর সাত বছর পর রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। মহাসংকটে পড়ায় শ্রীলঙ্কা অবশ্য আকুর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। গত এপ্রিল মাসে ৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে ছয় মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে।
প্রতি দুই মাসের বিল পরবর্তী মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধ করে এসব দেশ।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার, মার্চে ১ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন এবং মে মাসে পরিশোধ করা হয় ১ দশমিক ১৮ বিলিয়নি ডলার।
ডলার সংকটের এ সময়ে রিজার্ভের অবস্থান ধরে রাখতে আমদানি খরচ কমানোর পাশাপাশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার জোর চেষ্টা করছে সরকার।
বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার পর বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত (১১ মাস, জুলাই-মে) আমদানি ব্যয় কমেছে ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ।
রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের পুরো অর্থবছরের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে।
আর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেড়েছে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে জুনে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার এসেছে। যা তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
গত ২ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। এর পর বিশ্ব ব্যাংকের বাজেট সহায়তার ৫০ কোটি ডলার যোগ হয় রিজার্ভে।
গত ২৬ জুন ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তা ঋণের ৫২ কোটি ডলার রিজার্ভে যোগ হয়েছে।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। এরপর থেকেই কমছে রিজার্ভ। এক বছর আগে ৫ জুলাই রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফের হিসাবে রিজার্ভ ২৪.৩৮ বিলিয়ন ডলার
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ‘গ্রস রিজার্ভ’ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার থাকলেও বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতিতে হিসাব করলে এই রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি সামাল দিতে গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ।
ওই সময়ে সংস্থাটি পূর্বাভাস দিয়ে বিবৃতিতে বলেছিল, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ নাগাদ ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে।
ঋণ সমঝোতার পর আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শ আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশ আইএমএফের সেই পরামর্শ মানতে রাজি হয়।
গত ১৮ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, “আইএমএফ সদস্য অন্যান্য দেশগুলো বিপিএম৬-এর ফর্মুলা কার্যকর করেছে। আমরাও সেটা কার্যকর করবো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবও থাকবে।”
গভর্নর রউফ তালুকদার বলেন, “আমরা রিজার্ভ থেকে যেসব বিনিয়োগ করেছি সেগুলো ঝুঁকিমুক্ত। আমাদের সব ঋণের গ্যারান্টার রয়েছে। সব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত পাবে। শ্রীলংকার লোনও আমরা ফেরত পেতে পারি তাদের স্থানীয় মুদ্রায় সমন্বয়ের মাধ্যমে।”
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক মোট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করে আসছিল। কিন্তু বেশ কিছুদের ধরে আইএমএফ এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশ ব্যাংক মোট যে রিজার্ভের হিসাব দিচ্ছে, তাতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), শ্রীলঙ্কাতে দেওয়া ২০ কোটি ডলার ঋণসহ অন্য কয়েকটি প্রকল্পে বিনিয়োগকে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হচ্ছে।
আইএমএফ বলছে, এটা রিজার্ভের নিট বা প্রকৃত হিসাব নয়। কেননা, এই মুহূর্তে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ সরকার রিজার্ভ থেকে যে অর্থ অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বা ঋণ দেয়া হয়েছে, তা ব্যবহার করতে পারবে না।
আপৎকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য রিজার্ভের যে অর্থ তাৎক্ষনিক খরচ করা যাবে সেটাকেই প্রকৃত রিজার্ভ হিসেবে হিসাব করতে বলে আসছিল আইএমএফ।
এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি আমলে না নিলেও ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ায় আইএমএফের এই শর্তটি এখন বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে সরকারকে।
আইএমএফের ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে মানতে হবে ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) ফর্মুলা।
বিপিএম-৬ ফর্মুলা মেনে হিসাব করলে বৃহস্পতিবার দিন বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে ইডিএফের ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এবং শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার ও কয়েকটি প্রকল্পের ৮০ কোটি ডলারসহ মোট ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে বিপিএম-৬ ফর্মুলা অনুযায়ী রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার।
আকুর দেনা পরিশোধের আগে প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের মত। আইএমএফের শর্ত ছিল ৩০ জুনের আগে প্রকৃত রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার থাকতে হবে।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আইএমএফের শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। সে কারণে সংস্থাটির দ্বিতীয় কিস্তির ৬০ কোটি ডলার পেতে সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক পরিষি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “আশার কথা হচ্ছে কোরবানির ঈদের কারণে জুন মাসে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে। রপ্তানি আয়ও ওই মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সে কারণেই রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের উপরে উঠেছিল। আকুর বিল শোধের পর তা আবার ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।”
“এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে রিজার্ভ যাতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে না নামে আর আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ হিসাবে ২৫ বিলিয়ন ডলারের উপরে অবস্থান কারে-সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”
“আর এ জন্য রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ানোর পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কম সুদের ঋণ-সহায়তার পাওয়ার জন্যও জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে,” দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
কমেন্ট