রিজার্ভ থেকে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ডলার বিক্রি

রিজার্ভ থেকে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ডলার বিক্রি

রিজার্ভ থেকে গেলো ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ডলারের অস্থির বাজার সুস্থির করতে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে গেলো ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ১ হাজার ৩৫৮ (১৩.৫৮ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রিজার্ভ থেকে এত ডলার বাজারে ছাড়া হয়নি। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। বেড়েই চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাটির দর। দুর্বল হচ্ছে টাকা। 

২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হ্রাস এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ডলারের দর ধরে রাখতে উল্টো ৭ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। 

বিদায়ী অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে যে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে, তা বাজারের থেকে কম দামে বিক্রি করা হয়েছে। কয়েক দফা বাড়ানোর পর গত অর্থবছরের শেষ দিন পর্যন্ত ১০৬ টাকা দরে ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

তবে আর কম দামে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে  না বাংলাদেশ ব্যাংক। ২ জুলাই থেকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরে ডলার বিক্রি করা হয়েছে। 

গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্ঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর ছিল ১০৯ টাকা। রিজার্ভ থেকেও এই দরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে এই দরে ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

রিজার্ভের উপর চাপ কমাতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। 

তবে সব ব্যাংক কম দামে  ডলার পায়নি। সরকারের জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে কম দামে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্য ব্যাংকগুলোকে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে আমদানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। 

এদিকে রিজার্ভ কমে আবার ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। গত বুধবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। বৃহস্পতিবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ১ বিলিয়ন (১০৯ কোটি ৬০ লাখ) ডলার পরিশোধ করা হয়। 

আর এর ফলেই ওদিন দিন শেষে রিজার্ভ কমে ২৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। 

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন এবং কয়েকটি দাতাসংস্থার কাছ থেকে ঋণ-সহায়তা পাওয়ায় কোরবানি ঈদের আগে ২৫ জুন রিজার্ভ বেড়ে ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। 

এর  আগে এই সূচক কমতে কমতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে, ২৯ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর সাত বছর পর রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ-এবিবি এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন-বাফেদা আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর নির্ধারণ করে থাকে। 

গত ১৮ জুন ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, রিজার্ভ থেকে কম দামে আর ডলার বিক্রি করা হবে না।  

সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্যই গত ২ জুলাই একদিনে  ডলারের দর ১০৬ টাকা থেকে ২ টাকা ৮৫ পয়সা বাড়িয়ে ১০৮ টাকা ৮৫ পয়সা করা হয়। অর্থাৎ আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারের দরের সমান করা হয় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দর। ওই দিন আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারের প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৮৫ পয়সায় বিক্রি হয়েছিল। 

আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর উঠা-নামা করলে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দর বাড়ানো-কমানো হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান। 

 মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, “বাণিজ্যিক ব্যাংকের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে। রিজার্ভ কমার এটাও একটি কারণ। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক আর ডিসকাউন্ট রেটে ডলার বিক্রি করবে না। বাজার দর অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে সবাইকে ডলার কিনতে হবে।”  

অর্থাৎ এখন থেকে আন্ত:ব্যাংকে ডলারের যে দর উঠবে সেই দরে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।  

২০২১-২২ অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পণ্য আমদানির এলসি বা ঋণপত্র খোলার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার নেয়। 

কারণ সরকারি এলসিতে জ্বালানি তেলসহ আরও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি করতে হয়। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এলসি খোলার ক্ষেত্রে অর্ধেক ডলার নিজেদের থেকে এবং বাকি অর্ধেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দর আন্তঃব্যাংক ডলারের দরের সমান করা হয়েছে, যাত রিজার্ভের ওপর চাপ কম পড়ে।”  

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ৪ মে থেকে রিজার্ভ থেকে প্রতি ডলার ১০৪ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করা হচ্ছিল। জুন মাসে দুই দফায় তা ১ টাকা ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১০৬ টাকা করা হয়েছিল।     

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়।   

পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় এবিবি ও বাফেদাকে।   

এর পর থেকে এই দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে।

‘দক্ষ কর্মীর অভাবে ১০ বিলিয়ন ডলার  বিদেশে চলে যাচ্ছে’ পরবর্তী

‘দক্ষ কর্মীর অভাবে ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে’

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর