রিজার্ভ বাড়ার কোনো লক্ষণ নেই
গত দেড় মাসে ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৬৫ কোটি ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে কমেছে ৪১ কোটি ডলার।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমছেই; বাড়ার কোনো লক্ষ্য নেই।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে; তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে।
সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। তবে এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভ। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
আগের সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (১৬ আগস্ট) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো নিয়ে সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে রিজার্ভের হালনাগাদ এই তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ১২ জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ওই দিন ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত দেড় মাসে ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৬৫ কোটি ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে কমেছে ৪১ কোটি ডলার।
সবশেষ গত জুন মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
আমদানি খাতে ব্যয় কমার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে। জ্বালানি তেল, সার, খাদ্যপণ্যসহ সরকারের অন্যান্য আমদানি খরচ মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণেই রিজার্ভ কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। এই রেমিটেন্স বাড়ায় কোরবানির ঈদের আগে ‘গ্রস’ রিজার্ভ বেড়ে ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।
কিন্তু জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ আবার ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর থেকে কমছেই।
আগামী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
দুই মাস পর পর আকুর দেনা পরিশোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাব করতে বাংলাদেশ সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিল।
কিন্তু বাংলাদেশ সে বিষয়টি আমলে নেয়নি। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি সামাল দিতে গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ।
ঋণ সমঝোতার পর আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শ আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের সেই শর্ত বা পরামর্শ মেনেই এখন রিজার্ভের দুই ধরনের তথ্যই প্রকাশ করছে।
হুন্ডি বাড়ায় বাড়ছে না রেমিটেন্স
রেমিটেন্সে সুখবর নেই। দফায় দফায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ানোর পরও রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে না
অবৈধ হুন্ডি বন্ধ না হওয়ার কারণেই ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কম আসছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দর বাড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন তারা।
বৃহস্পতিবার কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১১৬ টাকা ৩০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠালে আড়াই শতাংশ প্রণোদনাসহ যা পাওয়া যায়, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে তার চেয়েও ৪/৫ টাকা বেশি পাওয়া যায়। সে কারণেই সবাই হুন্ডির দিকে ঝুঁকছে বলে জানিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের ১৮ দিনে (১ থেকে ১৮ আগস্ট) ১০৪ কোটি ৫ লাখ ৯০ হাজার (১.০৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। মাসের বাকি দিনগুলোতে এই হারে আসলে, মাস শেষে ১৭৯ কোটি ১৯ লাখ ডলার আসবে।
সে হিসাবে আগস্টে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের চেয়েও কম রেমিটেন্স দেশে আসবে।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য এখন ১০৯ টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে এই ১৮ দিনে (১ থেকে ১৮ আগস্ট) ১১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসী ভাই-বোনেরা; প্রতিদিনের গড় হিসাবে পাঠিয়েছেন ৫ কোটি ৭৮ লাখ ডলার বা ৬৩০ কোটি টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আর গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ (২.০৩ বিলিয়ন) ডলার। প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ (২.১০ বিলিয়ন) ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই ও আগস্ট) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২ বিলিয়ন ডলারের কম এসেছে। ১৮ দিনে যে হারে এসেছে, সেই হারে আসলে আগস্ট মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের অনেক কম প্রবাসী আয় দেশে আসবে।
গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন (২২০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। যা ছিল একক মাসের হিসবে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ; তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
এই হিসাব বলছে, অর্থনীতির অন্যতম সূচক রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক ধারা নিয়েই ২০২৩-২৪ অর্থবছর শুরু হলো।
কমেন্ট