রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি চলছেই, ২ মাস না যেতেই ২ বিলিয়ন বিক্রি
আর এই বিক্রি রিজার্ভ কমার একটি কারণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অস্থির ডলারের বাজার সুস্থির করতে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল।
সেই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) না পেরোতেই প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে। সবশেষ গত বুধবার পর্যন্ত (২৩ আগস্ট) রিজার্ভ থেকে এই ডলার বিক্রি করা হয়েছে। আর এই বিক্রি রিজার্ভ কমার একটি কারণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি কমায় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ২০২১ সালের আগস্টে এই রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের (গ্রস রিজার্ভ, তখন বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করা হত না) মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।
এরপর আমদানি বাড়ায় এবং রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স হোঁচট খাওয়ায় রিজার্ভ কমতে থাকে। চাপ বাড়তে থাকে অর্থনীতিতে। বেশ কিছু দিন ধরে আমদানি কমলেও রিজর্ভের পতন ঠেকছে না।
২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। আমদানি কমায় এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের রেমিটেন্স বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ডলারের দর ধরে রাখতে ২০২০-২১ অর্থবছরে উল্টো বাজার থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার দরেই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করত। বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করত, সেটিকে ‘ইন্টার ব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেট’ বা ‘আন্তব্যাংক লেনদেন হার’ নামে অভিহিত করা হতো। ব্যাংকগুলোর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে দরে ডলার বিক্রি করত, তখন সেই দরকেই ডলার রেট ধরা হতো।
তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী বিদেশি ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ডলারের দর নির্ধারণ করছে।
এই দরকেই এখন আন্তঃব্যাংক রেট বলা হচ্ছে। এই রেটেই ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে ডলার কেনোবেচা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দশনার আলোকেই এই দর নির্ধারণ করছে এবিবি ও বাফেদা। রোববার এই দর ছিল ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা।
ডলারের দর নির্ধারণের দায়িত্ব বাফেদা ও এবিবির উপর ছেড়ে দেওয়ার আগে বাজারের চেয়ে কম দামে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করত বাংলাদেশ ব্যাংক।
কিন্তু চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দিন (১ জুলাই) থেকে আর কম দামে ডলার বিক্রি করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরেই ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে যে ডলার বিক্রি করছে, তা জ্বালানি তেল, সার, খাদ্যপণ্যসহ সরকারের অতি প্রয়োজনীয় খরচ মেটানোর জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টের ২৩ দিনে রিজার্ভ থেকে মোট ১৯৬ কোটি ৩০ লাখ (১.৯৬ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
এর মধ্যে জুলাইতে বিক্রি করা হয় ১১৪ কোটি ৭০ লাখ (১.১৫ বিলিয়ন) ডলার। আর চলতি মাস আগস্টের প্রথম ২৩ দিনে বিক্রি করা হয় ৮১ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের (জুলাই থেকে ২৩ আগস্ট) একই সময়ে ডলার বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৭৭ কোটি ৮০ লাখ (১.৭৭ বিলয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। যা দেশের স্বার্থেই করা হচ্ছে।”
‘ডলার পর্যাপ্ত আছে বলেই বিক্রি করা হচ্ছ ‘ জানিয়ে তিনি বলেন, “রিজার্ভও ভালো অবস্থানে রয়েছে। কেননা, বর্তমানে রিজার্ভে যে পরিমাণ ডলার রয়েছে তা দিয়ে ৫ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশের রিজার্ভের অর্থ দিয়ে ৩ মাসের আমদানি মেটানোকে স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়।”
সবশেষ গত জুন মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আমদানি খাতে ব্যয় কমার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে। জ্বালানি তেল, সার, খাদ্যপণ্যসহ সরকারের অন্যান্য আমদানি খরচ মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণেই রিজার্ভ কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। এই রেমিটেন্স বাড়ায় কোরবানির ঈদের আগে ‘গ্রস’ রিজার্ভ বেড়ে ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।
কিন্তু জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ আবার ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর থেকে কমছেই।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
দুই মাস পর পর আকুর দেনা পরিশোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাব করতে বাংলাদেশ সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিল।
কিন্তু বাংলাদেশ সে বিষয়টি আমলে নেয়নি। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি সামাল দিতে গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ।
ঋণ সমঝোতার পর আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শ আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
বাাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের সেই শর্ত বা পরামর্শ মেনেই এখন রিজার্ভের দুই ধরনের তথ্যই প্রকাশ করছে।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রিজার্ভ কিন্তু কমতে কমতে অনেক কমে গেছে। আর কমতে দেওয়া যাবে না। তাহলে কিন্তু সংকট আরও বেড়ে যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করছে যত কম এলসি (পণ্য আমদানির ঋণপত্র) খোলা হয়। তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। জুলাই মাসে এলসি কমেছে ৩১শতাংশের বেশি।”
“কিন্তু তারপরও রিজার্ভ কমছেই। আকুর দেনা শোধের পর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আরও কমে যাবে।”
কমেন্ট