শ্রীলঙ্কার সেই ঋণের আরও ১০ কোটি ডলার ফেরত পেল বাংলাদেশ
চরম আর্থিক সংকটে পড়ে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ তলানিতে নেমে আসায় দুই বছর আগে বাংলাদেশের কাছে ঋণ চেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সে সময় শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছিল; রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল।
শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া সেই ২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের আরও ১০ কোটি কোটি ডলার ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ। ১০ দিনের ব্যবধানে আরও ১০ কোটি ডলার ফেরত দিয়েছে দেশটি।
চরম আর্থিক সংকটে পড়ে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ তলানিতে নেমে আসায় দুই বছর আগে বাংলাদেশের কাছে ঋণ চেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সে সময় শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছিল; রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল।
সংকট কাটিয়ে এখন শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। শোধ করে দিচ্ছে সেই ঋণ। তারই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার ১০ কোটি ডলার ফেরত দিয়েছে। ১০ দিন আগে ২০ আগস্ট ৫ কোটি ডলার ফেরত দিয়েছিল।
সব মিলিয়ে দুই কিস্তিতে ২০ কোটি ডলার ঋণের ১৫ কোটি ডলার ফেরত দিল শ্রীলঙ্কা। অর্থাৎ মোট ঋণের ৭৫ শতাংশই ফেরত দিয়েছে দেশটি। ফলে শ্রীলঙ্কার কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাওনা থাকল আর পাঁচ কোটি ডলার।
২০২১ সালের মে মাসে এক বছর মেয়াদে এ ঋণ নিয়েছিল দেশটি। তবে গত বছর অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হলে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কা। সে কারণে কয়েকবার ঋণ পরিশোধে সময় নেয় তারা। চলতি বছর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই ঋণের বাকি ৫ কোটি ডলার ফেরত দেবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে দেশটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক শুক্রবার এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “শ্রীলঙ্কা বৃহস্পতিবার আমাদের কাছে ১০ কোটি ডলার ফেরত দিয়েছে। বাকি ৫ কোটি ডলার তারা চলতি সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই ফেরত দেবে জানিয়েছে।”
যদিও তিন কিস্তিতে নয় মাসের মধ্যে এই ঋণ পরিশোধের কথা ছিল। তবে আর্থিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কার অনুরোধে ঋণ পরিশোধের সময় তিন বার বাড়িয়ে ২৭ মাস করা হয়েছে।
বর্ধিত মেয়াদ সেপ্টেম্বরে শেষ হবে বলে জানান মেজবাউল হক।
চুক্তি অনুযায়ী, ঋণের বিপরীতে শ্রীলঙ্কা লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফার রেট (লাইবর) এর পাশাপাশি বাংলাদেশকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ সুদ প্রদান করার কথা।
মেজবাউল হক জানান, চুক্তি অনুযায়ী শ্রীলঙ্কা ১ দশমিক ৫ শতাংশ সুদের পাশাপাশি লাইবর হার যোগ করে দুই কিস্তিতে পাওনা পরিশোধ করেছে।
বাকি ৫ কোটি ডলারও একইভাবে পরিশোধ করবে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা।
বিদেশি মুদ্রার সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কাকে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় ২০২১ সালের আগস্ট-অক্টোবর সময়ে চার কিস্তিতে ২০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশ।
ওই বছরের ১৮ আগস্ট প্রথম কিস্তির ৫ কোটি ডলার ছাড় করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই ঋণ ছাড়ের মাধ্যমে ঋণদাতা দেশের তালিকায় নাম লেখায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ওই ঋণ দেওয়া হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল (গ্রস হিসাাবে) ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
একবছর মেয়াদি ঋণের মেয়াদ শেষ হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। এরপর তিন মাস করে কয়েক দফায় সময় বাড়ানো হয়। ঋণের বিপরীতে লন্ডন আন্ত:ব্যাংক অফার রেট বা লাইবর যোগ করে দেড় শতাংশ সুদ পাচ্ছে বাংলাদেশ।
শ্রীলঙ্কার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তাদের ঋণ দেওয়ার নীতিগত অনুমোদন হয়। এরপর চুক্তিনামা তৈরিসহ কিছু প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে।
যেসব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কম তারা বিপদে পড়লে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ নেয়।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়। তবে শ্রীলঙ্কার ওই মুহূর্তে সেটি ছিল না।
ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়ায় শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ কমতে কমতে একেবারে তলানিতে নেমে এসেছিল। দুই সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভও ছিল না।
সংকট মেটাতে বন্ধুপ্রতীম দেশ বাংলাদেশের কাছ থেকে ঋণ চেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিল।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতির কারণে দ্বীপরাষ্ট্রটি ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার জন্য আলোচনা করছে।
আইএমএফের বেলআউটের জন্য অপরিহার্য হলো বহিরাগত ঋণ পুনর্গঠন করা, যা সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
এদিকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। দেশটির মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। দুই বছরের মধ্যে প্রথমবার দেশটির মূল্যস্ফীতি এক অংকের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) নেমেছে।
পর্যটন ও রেমিটেন্স থেকে আসা ডলারের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। বিষয়টি ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে আইএমএফের বেলআউট পেতে দেশটিকে সহায়তা করবে আশা করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাত ব্যাপক ক্ষতিতে পড়েছিল। বৈদেশিক বিনিময়ে প্রতিনিয়ত মান হারাতে শুরু করে দেশটির মুদ্রা রুপি।
এতে টান পড়ে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতে। এমন পরিস্থিতিতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ডলার ধার করে শ্রীলঙ্কা। এরই অংশ হিসেবে ২০২১ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সরকারও ২০ কোটি ডলার ঋণ দেয় দেশটিকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এ ডলার দেওয়া হয়।
‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০২১ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে।
ওই বৈঠকের ধারাবাহিকতায় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ডব্লিউ ডি লক্ষ্মণ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে ডলার চেয়ে চিঠি দেন। এরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ধার বা ঋণ হিসেবে নয়, বরং ডলারের সঙ্গে শ্রীলঙ্কান রুপি অদলবদল বা সোয়াপ করেই তা দেওয়া হয়।
এর বিপরীতে কিছু সুদও পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কাছে ২০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ শ্রীলঙ্কান রুপি জমা ছিল। এর মধ্যে ১৫ কোটি ডলার শোধ করায় ইতিমধ্যে সমপরিমাণ রুপি দেশটিকে ফেরত দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সংকট কাটাতে শ্রীলঙ্কাকে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার দিয়ে সহায়তা করেছিল যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভই এখন বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বৃহস্পতিবার দিন শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক শূন্য ছয় বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩০৬ কোটি ডলার। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
কমেন্ট